ঘরবাড়ি হারিয়ে মন্দিরে ঠাঁয়


শফিকুল ইসলাম, শিবগঞ্জ অফিস প্রধান:
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের জহরপুর সার্বজনিন দূর্গা মন্দিরের সামনে, চুলায় রান্না করছেন এক নারী। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে মন্দিরের কাছে যেতেই আরো দেখা যায়  মন্দিরের ভেরতে অনেক আসবাব পত্র। মন্দিরের অন্যত্রও একই অবস্থা। মন্দিরের সামনে চুলায় রান্না করা নারীর নাম  সনোকা রানী। কথা হতেই জানালেন, তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ায়, গত এক সম্পাহ থেকে মন্দিরেই আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু সনোকা রানী না, মন্দিরের আশ্রয় নিয়েছেন আরো ৮টি পরিবার। শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের জোহরপুর গ্রামের অন্তত ২০টি বাড়ির মাটি দেবে যাওয়ায়, ভেঙ্গে পড়েছে। সারাজীবনের সঞ্চয়ে গড়া মাথা গোজার ঠায় হারিয়ে এখন পরিবারগুলো দিশাহারা। মন্দির সহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
রান্না করতে করতে সনোকা রানী বলছিলেন, তারা হালদার সম্প্রদায়ের, তার স্বামী মাছ ধরে, মাঝে মধ্যে অন্যকাজও করত। ৫ বছর আগে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটা গরু, কিনেছিলেন, সেই গরু লালনপালন করার পর বিক্রি করে পেয়েছিলেন এক লাখ টাকা। তারপর মোট সাড়ে তিন লাখটা ঋন নিয়ে দুটা পাকা ঘর করেছিলেন, আর দুটো টিনের ঘর। দুই ছেলে ছেলের বউসহ পরিবার সবাইকে নিয়ে ভালই কাটছিল তাদের। এতোদিনে কষ্ট করে বাড়ির তৈরীর সেই ঋনের কিস্তিও শোধ করেছিলেন। তার পরিবারের সবার উপার্যনে কষ্টে গড়া বাড়িটা গত সপ্তাহেই পুরোপুরি ধ্বংসস্তপে পরিনত হয়েছে। সবকিছু হারিয়ে তারা এখন মন্দিরে থাকছেন।  
সনোকা রানী বলছেন‘‘ হাতে খাটে প্যাটে খায়, স্বামী মাছ মারে, ছেলেরা মাছ মারে, রিক্সা চালায়, যখন যেটা পায় তখন সেটা করে,এটার উপরই বাড়িটা বানিয়্যা ছিলাম, এখন পুরাটায় ভ্যাঙ্গা গেছে। এখন মন্দিরে ৮দিন থ্যাকা আছি, আমার মত আরো ৮-৯ঘর আছে।’
কি চান এখন জানতে চাইলে, সনোকা রানী বলেন আমার একার জন্য চাইলে তো হবে না, আমি চাই সরকার আমাদের সবার জন্য, যেটা ভাল হয় সেটা করে দিক। আমাদের সবার জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিক সরকার।
কবে থেকে ফাঁটল দেখা দিয়েছে জানতে চাইলে সনোকা রানী বলেন, খালের পাড়গুলো গতবছরই দেবে গেছিলো ওই সময় আমার নিচ দিকের ঘর গুলোতে ফাঁটল দেখা দিয়েছিলো, এবছর একবারই সব ধ্বসে গেল। ঘরবাড়ি সব শেষ হয়্যা গেছে সবার।
মন্দিরের পাশেই একটু এগিয়ে যেতে, দেখা গেল টিনের একটা চালার খুটিতে মাথা দিয়ে বসে আছেন শ্রী সুন্দরী রানী। তার পুরো বাড়ির মাটি দেবে যাওয়া, বাড়ির ছাদটা এখন সমতল হয়ে গেছে। অনেকেই দেখতে আসছেন দেবে যাওয়া বাড়িটি। এখন সুন্দরী রানীর বাড়িতে রাজ্যের ভিড়, এতো মানুষের ভিড়ে মাথা গোজার ঠায় হারানো সুন্দরী রানী পাগল প্রায়।
সুন্দরী বলেন তার ছোট ছেলে ছোটন বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার ঘটনার পর থেকে ক্ষনে ক্ষনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। তাকে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হয়েছিলো বলেও জানান তিনি।  

শুধু সনোকা রানী বা সন্দরী রারী না আরো যাদের বাড়িঘর দেবে গেছে তারা সবাই যে যার মত অন্যের বাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন। কারো কারো বাড়ি ঝুকিপূর্ণ ঘোষনা করা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তারপরও অনেকেই তাদের বাড়িতেই থাকছেন।
শ্রী রুপচান হালদার তেমনি একজন যিনি ঝুকি নিয়েই নিজ বাড়িতে আছেন। তিনি বলেন মাটি দেবে যাওয়ায় বাড়ির দুটো ঘর তিনি নিজেই ভেঙ্গে ফেলেন, এতে অন্য ঘরগুলোসহ তার পুরো বাড়ি রক্ষা করা গেছে বলে তার ধারনা। যদিও তাকে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছে স্থানীয় প্রশাসন।
রুপচান হালদার বলেন ‘‘ সবাই আসছে আর বলছে বাড়ি থ্যাইকা চল্যা য্যাতে, হামার একটা পলিথিক কিন্যা যে ট্যাংঙ্গা থাকব সে টাকা নাই, হামার বাড়ি ছাড়া থ্যাকার কোন জাগা নাই। এমনকি যে দুখান ঘর ভাংতে হয়্যাছে, সেটায়ও ধারদেনা করা কর‌্যাছি।’’
কানসাট সোলায়মান ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক ও স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন জানান, ওই  এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা বড় নালাটির পাড়েই অধিকাংশ হারদার সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের ঘর তুলে বসবাস করছিলেন অনেকদিন থেকে। সময়ের সাথে সাথে পরিবারগুলো তাদের বাড়িঘরও বাড়িয়েছে, অনেকটা নিচু জায়গা ভরাট করে তারা নতুন করে বাড়িঘর গুলো করেছিলো, বাড়িঘরের যে ভার সেটা এখানকার মাটি ধারন করতে না পারায় এমনটা হয়ে থাকতে পারে।
মঙ্গলবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা, দেবে যাওয়া ওই এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন জানান, ওই এলাকার বাড়িগুলো খাল ঘেঁসেই বানানো, সেখানকার মাটির অবস্থা খুবই রাখাপ যার কারনেই দেবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আরেকটা বিষয় দেখলাম বিক্ষিপ্ত ভাবে ওই এলাকার পানি খালে নামত, এটাও ধ্বসের একটা কারন হতে পারে। তবে তিনি বলেন খালের পানি থাকা বা না থাকার সাথে মাটি দেবে যাওয়ার কোন বিষয় নেই।
মোবারকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান  বলেন, অন্তত ২০টি বাড়ি দেবে গেছে, ১০-১২ টি বাড়িতে ফাটল ধরছে, ওখানকার লোকগুলো অত্যান্ত গরিব, এর কষ্ট করে, বাড়ি গুলো করেছিলো। বাড়ি আর তাদের করার সুযোগ, আরকখনো হবে কিনা তা আমি জানি না, সরকারি ভাবে, আমি ইউএনও ও এমপিকে আবেদন করেছি, মৌখিকভাবে আবেদন করেছি, তারাও নিজেরাও দেখে গেছেন। এখানে দু-পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সমাধান নাই,এখানে সরকারি ভাবে বড় হস্তক্ষেপ না করলে এ গরিব পরিবারগুলোর দূর্দশা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমি সরকারের কাছে এটার সরাহা করার আবেদন করছি।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

0 Comments:

Post a Comment

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7