আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে সাহিত্যিকদের হাতে রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য । তবে ,বলার মত তেমন বড় সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি যা নিয়ে বিশ্ব মঞ্চে তা আলোচিত হবে । এটি আমাদের মন-বেদনার কারণ বটে । কয়েকজন নাট্যকার আমাদের সেই বেদনার ভার কিছুটা লাঘব করেছেন - সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মমতাজউদ্দীন আহমদ, আলাদ্দিন আল আজাদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, নীলিমা ইব্রাহীম ,জিয়া হায়দার , মোহাম্মদ এহসানুল্লাহ , সাঈদ আহমদ, রণেশ দাশগুপ্ত তাঁদের ভিতর আলোচিত নাম । সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) ‘ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’(১৯৭৫) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ(১৯২২-৭১ ) ‘তরঙ্গভঙ্গ’ (১৯৬৫) এরপর যে নামটি বেশি আলোচিত তিনি নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ ( ১৯৩৫-২০১৯) আমাদের সাহিত্য জগতে একজন কীর্র্তিমান নাট্যব্যক্তিত্ব । এখন পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক রচনা করেছেন । যা নানাভাবে আলোচিত হয়েছে । স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা (১৯৭১) , বকুলপুরের স্বাধীনতা , বর্ণচোর , নাটক ‘কি চাহ শঙ্খচিল’(ফেব্রুয়ারি,১৯৮৫) নাটক রচনা করেছেন তিনি।
‘কি চাহ শঙ্খচিল’ নাটকে তিনি মুক্তিযুদ্ধপরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে মানুষের পাওয়া না পাওয়ার বেদনা , হারানোর বেদনা মূর্তি নির্মাণ করেছেন । আজকাল যে বীরাঙ্গনাদের ( বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীদের জন্য একটি খেতাব) নিয়ে কথা হয় তাঁরই একটি চিত্র চিত্রিত হয়েছে এই নাটকে । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাস্তবে বীরাঙ্গনার অবস্থার নাটকীয় উপস্থাপনা দেখা যায়- এখানে । রৌশনারা (২৮) সেই নারী যার সন্তান ‘লালন’ , যে কিনা ‘শান্ত ছেলে । কিন্তু খুব জেদী । কবি নজরুল ইসলামের মতো । ’ যে সন্তানের বয়স ছয় বছর হয় এক সময় । কিন্তু সন্তানের পরিচয় নিয়ে এক সময় সংকট দেখা দেয় । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রৌশনারাকে মিলিটারি ছাউনিতে বারদিন বন্দী থাকতে হয় এ থেকেই জের বাইরে কথা উঠলে স্বামী আলী নেওয়াজ শ্বাসরোধ করে হত্যা করে লালনকে । ছেলেকে বাঁচানোর জন্য রৌশনারাকে মানসিক হাসপাতালে পাগল চিহ্নিত করে ভর্তি করিয়ে দেন তার শ্বশুর জনাব আলী সাহেব(৬০) । এমন প্রেক্ষিতে রৌশন এর কণ্ঠে নাট্যকার যে ডায়লোগ তুলে দিয়েছেন- ‘জন্তুদের বাংকার থেকে ফিরে এলাম লাঞ্ছনা আর লজ্জার আকণ্ঠ বিষপান করে । ঘৃণাতে সূর্যের দিকে তাকাতে পারতাম না , চাঁদের আলো পাছে ঘরে ঢোকে সেজন্য জানালা কপাট বন্ধ করে নিজেকে লুকিয়ে রাখছিলুম । কিন্তু তোমাদের সহানুভূতি আর উদারতা ঘোষণার প্রয়োজনে আমাকে বার বার অসংখ্যবার প্রদর্শনী মঞ্চে এসে দাঁড়াতে হলো । আমি যেন একটা লেজকাটা শৃগাল, পোকা খাওয়া টকটকে ডালিম । তবু তোমাদের কৌতুক মেটে না , বিশালাকার মহিলাদের কান্না থামে না । শিবিরের ঘৃণ্য বিষ , আর তোমাদের গদগদ অমৃত পান করছি । ... ... ...
... .. .. যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা আনল তাগোর কোন খবর নাই আমার ল্যাজকাটার খবরটা বিস্তার করার জন্য মাইক ভাড়া করার সেকি ধুম ।’
এমন শত শত গল্প ছড়িয়ে রয়েছে আমরা জানি না । জানতে চাই না তার বেদনার কথা । কখন কখন সেই কথা মূর্ত হয় লেখকের কলমে । বর্তমান সময়ের নাটকে সেই গল্প অতি সামান্য আসে দিবসকে ঘিরে । মুক্তিযুদ্ধ যেন দিবস পালনের ভিতর দায়িত্ব শেষের বিষয় । মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরও নাটক চাই এই বাংলাদেশে । নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সত্য ঘটনা তুললে ধরা অনন্য মাধ্যম আমাদের নাটক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যধারা।
নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ তাঁর নাটকের ভিতর দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন । তুলে ধরেছেন সমাজবাস্ততা । মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য এমন লেখা আমাদের সাহিত্য ভা-ারে কম রয়েছে । তা বিজয়ের ৪৮ বছরে এসে সেই সব বীরাঙ্গনাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি , সেই সঙ্গে নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদকে যার লেখনী আমাদের প্রাণিত করে দেশপ্রেমের প্রতি ।
তথ্যসূত্র:
১.মমতাজউদ্দীন আহমদ। বিবাহ ও কি চাহ শঙ্খচিল৷(১৯৮৫) বাংলা একাডেমি, ঢাকা
২. কবীর চৌধুরী। নাট্যাসমালোচনা
১.মমতাজউদ্দীন আহমদ। বিবাহ ও কি চাহ শঙ্খচিল৷(১৯৮৫) বাংলা একাডেমি, ঢাকা
২. কবীর চৌধুরী। নাট্যাসমালোচনা
লেখক
জাফর জয়নাল
জাফর জয়নাল
jafourjkkniu@gmail.com
কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।