বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর : সদা জাগ্রত চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর বুকে

রক্তের সম্পর্কই বড় সম্পর্ক নয়; আত্মার সম্পর্কই আসল সম্পর্ক। বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর তেমনই এক সূর্য সন্তান, যিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্মগ্রহণ না করেও এই প্রিয় চাঁপাইনবাবগঞ্জকে মুক্ত করে আমাদের করে গেছেন চিরঋণী। 

মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৬৬ সালে আইএসসি পাস করার পর বিমানবাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখের অসুবিধা থাকায় ব্যর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালের ২ জুন তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটেলিয়ানে কর্তব্যরত ছিলেন। তবে ৩ জুলাই পাকিস্তানে আটকেপড়া আরো তিনজন অফিসারসহ তিনি পালিয়ে আসেন এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মোহদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন। বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে তাঁকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন। ১১ ডিসেম্বর সেখানে ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করার কথা ছিলো। কিন্তু সেটি হয়নি। পরবর্তী দুইদিন ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর একাধিকবার ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, শত্রুদের আক্রমণ করবেন। এই তরুণ সামরিক অফিসারের সর্বক্ষণ একটাই চিন্তা ছিল, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা। তাই ক্ষণিক অবসরে বাংকারে বসেও বিশ্বের নানান দেশের মুক্তিপাগল বিপ্লবীদের জীবনী পড়ে দীক্ষা নিতেন আর কৌশল শিখতেন । 

অবশেষে ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা ত্যাগ করে ৩-৪ টি নৌকায় মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন। নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে প্রত্যেকটি শত্রু অবস্থানের দখল নিয়ে দক্ষিণে এগোতে থাকেন। তিনি এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যেন উত্তর দিক থেকে শত্রু নিপাত করার সময় দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু কোনো কিছু আঁচ করতে না পারে। এভাবে এগোতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত, তখনই ঘটে বিপর্যয়। হঠাৎ বাঁধের ওপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮-১০ জন সৈনিক দৌড়ে এসে যোগ দেয় চর এলাকায়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তান বাহিনীর অবিরাম ধারায় গুলিবর্ষণ। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর জীবনের পরোয়া না করে সামনে এগিয়ে যান। ঠিক সেই সময়ে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জাহাঙ্গীরের কপালে। রক্তে রঞ্জিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি এই পৃথিবী ত্যাগ করলেন। পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সোনামসজিদ চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীরযোদ্ধা শহীদ মেজর নাজমুল হকের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। 

চাঁপাইনাবগঞ্জ শহরের রেহাইচর এলাকায় সড়ক ভবনের সামনে ঠিক তার শহীদ হওয়ার স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে মুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয় মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরকে।
আজ যে আমরা স্বপ্নের চাঁপাইনবাবগঞ্জের কথা বলছি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখছি তা সম্ভব হয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের বিনিময়ে। তাই বিজয়ের মাসে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী সর্বোপরি এই দেশবাসী কোনো দিন তার ঋণ শোধ করতে পারব না। তেমনই তিনি আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবেন। আমরা তাকে কোনো দিন ভুলতেও পারব না।

লেখক : প্রাক্তন শিক্ষার্থী,আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি

------------------------------------------------------------
কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7