মেহেদীর রং না মুছে গেলেও, ফিকে এখন তোহরার স্বপ্ন

চাঁপাইনবাবগঞ্জে বুধবারের বজ্রপাতে ১৭ জনের প্রানহানীতে স্বামীকে হারিয়েছেন দুই নববধু। দুইজনই স্বামীর সাথে সেদিন আরেক নবদম্পতিকে আনতে নৌকায় করে যাচ্ছিলেন, বজ্রপাতে স্বামী মারা গেলেও তারা বেঁচে যান।

শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের মহারাজপুর ডাইলপাড়া গ্রামে তবজুল ইসলামের বাড়িতে এখনো শোকাবহ পরিবেশ। তবজুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয়, তবজুল ইসলামের নাতি বজ্রপাতে নিহত বাবলুর স্ত্রী তোহরা খাতুনের সাথে।  তোহরা খাতুনের মা শিল্পী বেগম মেয়ের সাথেই বসে ছিলেন। বলেন বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে তার মেয়ে, স্বামী বাবলু ও শ^াশুড়ী ল্যাচল বেগমকে হারিয়েছেন। মাত্র ২০ দিন আগে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন বাবলুর সাথে।

শিল্পী বলেন, তার স্বামী চট্টগ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে মারা যায়, স্বামীকে হারিয়ে চার মেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছেন, তার মেজ মেয়ে তোহরা, তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের স্বরুপনগরে শিশু পরিবার ( সরকারি এতিম খানা) রেখেছিলেন। সেখান থেকে এনেই বিয়ে দেন বাবলুর সাথে।

শিল্পী বলেন ‘‘ হ্যামিও স্বামী হারা হয়্যাছিলাম, হামার বেটিটাও স্বামী হ্যারা হয়্যা গেল, এখন কি করবে, শ^শুড়ীটাও থাকলে তাও হত, কেহই থাকল না, হামার বেটির’’।

নতুন সংসারে কতই না স্বপ্ন দেখেছিলো তোহরা খাতুন, নতুন একটা বাড়ি করার স্বপ্ন ছিলো তাদের দুজনের। ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করা বাবলু বাড়ি করার জন্য সঞ্চয় করেছিলেন কয়েক বছর থেকেই। বিয়ের পর নববধু তোহরাকে বলেছিলেন, কুরবানীর ঈদের কিছুদিন পরই বাড়ির কাজ শুরু করবেন।
স্বামীর সে কথা মনে করে তোহরা বলেন, ‘‘ বাড়ি করার ল্যাগা টাকা জমা কর‌্যাছিল, কহছিল যে মার (বাবলুর মা) কাছে কিছু টাকা লিব, আর হ্যামার কাছে কিছু আছে, দিয়্যা দুখান ঘর করব। হ্যামি ঈদের কহছি, যে এখন তো বস্যা আছো বাড়িতে, তো নতুন বাড়ির কাজ শুরু কর‌্যা দাও, কিন্ত ও তখন কহছিল ইট, সিমেন্টের দাম বেশি একটু কমলে কাজ শুরু করবে. কিন্তু  ওর আর হামার ল্যাগা বাড়ি করা হলো না, হামরাকে ছ্যাড়া চলা গ্যালো’’।

গত বুধবার বিয়ের দাওয়াতে স্বামীর সাথেই গিয়েছিলেন তোহরা, বজ্রপাতে আহত তোহরা হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতে জানতে পারেন তার স্বামী মারা গেছেন।



এতিম খানায় থেকে পড়ালেখা করেছেন তোহরা, বিয়ের কারনে পড়ালেখায় ছেদ পড়লেও, তিনি আবারো পড়ালেখা শুরু করতে চান, বলেন সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে আবারো পড়ালেখা শুরু করতে চান।
তোহরার মা শিল্পী বলেন, মেয়ের ইচ্চায় আমার ইচ্ছা, কিন্তু কি করব, কিভাবে চলবে সবকিছু আমার মাথায় কুলাচ্ছেনা। তবে মেয়েকে পড়ালেখা করাতে চান বলে জানান তিনি।  

শুধু তোহরা না, বিয়ের দাওয়াতের গিয়ে স্বামী আসিকুল ইসলামকে হারিয়েছেন টুকটুকি খাতুন। সুন্দরপুর ইউনিয়নের সেরাজুল ইসলামের ছেলে আসিকুল ইসলামের সাথে ৪ মাস আগে বিয়ে হয়েছিলো নারায়নপুর ইউনিয়নের জনতার হাট এলাকার মিজানুর রহমানের মেয়ে টুকটুকি খাতুনের। বজ্রপাত যেন টুকটুকির সংসারকে ছিন্নবিছিন্ন করে দিয়েছে।
স্বামীকে হারানো টুকটুকি এখন কথা বলার শক্তিটুকুই হারিয়ে ফেলেছেন। বলেন নৌকা থেকে নামার পর একটা টিনের ঘটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর কি হয়্যাছে কিছু বলতে পারব না, হ্যামি অজ্ঞান হয়্যা গেছিলাম। জ্ঞান যখন ফিরাছে তখন হাসপাতালেই ছিনু’’ ।

যার বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল সবাই, সেই মামুনের মা সেমালী বেগম বলেন ‘‘ যারা মারা গেছে তারা সবাই হ্যামার আতœীয়, হ্যামিও হামার স্বামীকে হারিয়েছি, কিন্ত বেশি খারাপ লাগছে, এই ছোট ছোট ছ্যালা গালাকে দেখ্যা। একটার বিহ্যা হয়্যাছিল ২০ দিন, আরেকটার বিহ্যা হয়্যা ছিল ৪ মাস। স্বামীহারা এই ছ্যালা গালাকে হ্যামি কি সাবুর দিব’’

উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নরায়নপুর ইউনিয়নের শরিফুল ইসলামের ছেলে মামুনের সাথে শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের হোসেন আলীর মেয়ে সুমির বিয়ে হয়েছিল গত এক আগষ্ট। পরের দিন কনে পক্ষ জামাই ও মেয়েকে (চাঁপাইনবাবগঞ্জের রীতি অনুযায়ী জামাই এর আটমোংলা) নিয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় রীতি অনুয়ায়ী, বুধবার সকালে ছেলে পক্ষ ছেলে ও ছেলের বউকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আনানা জন্য যাচ্ছিল কনের বাড়িতে।

সকাল ১০টার দিকে নারায়নপুর থেকে বর পক্ষের ৫০ জন যাত্রা করে নৌকায় কনের বাড়ির পথে। পদ্মা নদীর পার হয়ে তারা পাকা ইউনিয়নের পৌচ্ছেই গিয়েছিল। নৌকা ঘাটে পৌচ্ছানোর সময়ই শুরু হয় বৃষ্টি, নৌকায় থাকা অনেকেই ভিজে যায়। সাথে থাকা ছোটনা নৌকা থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভিজেই দৌড় দিয়ে পৌচ্ছে যায় কনের পক্ষের বাড়িতে। তবে বড় ও নারীরা প্রায় ২০ জনের মত আশ্রয় নেই ঘাটে থাকা একটি টিনের ছাউনিতে। এসময় বজ্রপাত হলে, সেখানে থাকা ১৭ জনই মারা যান।
 


 

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

0 Comments:

Post a Comment

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7