ভ্রমণ ভ্রমিয়া শেষে


পাহাড়ের গায়ে  এঁকেবেঁকে চলেছে সুনশান নিরবতা । লম্বা  লম্বা সেগুন , আকাশি গাছের ভিড়ে আরও নামগোত্রহীন গাছের সারি । বিস্তীর্ণ একটি বন । বনের ভিতর আমাদের যাত্রা । আমাদের এগারজনের দলে যুক্ত হয়েছেন সুদ্বীপ নামে এক কোচ ভদ্রলোক । সুদ্বীপদা’র বয়স আনুমানিক চল্লিশ । অল্পভাষী এই লোক খুব বেশি কথা না বলে আমাদের নিয়ে চললেন । আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা কোথায় যাচ্ছি কেউ জানি না । তবে কিছুক্ষণ আগের ঘোর অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাচ্ছি । রাতে থাকার জায়গা নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। পায়ে হাঁটা পথ। সন্ধ্যার আজান ভেসে আসছে বাতাসে । ঘন অরণ্যের ভিতর আমাদের দল ছাড়া অন্য কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই । দুই পাশে পাহাড় , মধ্যে দিয়ে রাস্তা । পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে । এখানেই নাকি মাঝে মাঝে লাশ পাওয়া যায় । লাশগুলো কাদের ? উত্তর বেশ কঠিন ।রাস্তাটি সুড়ঙ্গের মত নিচে নেমে গেছে খানিকটা আতঙ্ক বোধ করলাম । ঢালু সেই রাস্তা দিয়ে বের হতেই পেলাম চৌরাস্তা । আমরা সোজা পথ দিয়ে চললাম । আমাদের দলের প্রায় সবাই ক্লান্ত । কিছুক্ষণ পর  সন্ধ্যা পুরোপুরি নেমে এলো । বন থেকে বের হওয়ার পর পেলাম চাষবাসের জমি । কিছুদিন আগেই ধান কাটা হয়ে গেছে হয়তো । এখন বেশ ফাঁকা । আকাশের দিকে তাকালাম । সন্ধ্যা তারা কি উঠেছে ? সন্ধ্যা তারা আকাশে । পাহাড়ে কুয়াশা বেশ ঘন মনে হল । মাঠ দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর পেলাম লোকালয় । কিছু বাড়ি দেখা যাচ্ছে । বাড়িগুলোর ভিতর –কিছু বাড়ি টিন , কিছু বাড়ি মাটি, কিছু খড় দিয়ে তৈরি । প্রতিটি বাড়ি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা । কারণ কী ? হাতির আক্রমণ থেকে ঘর বাঁচানো । রাস্তায় খেয়াল করলাম ব্রীজ ভাঙা । শীতকাল বলেই বাঁচা গেলো । জল নেই নিচে । ব্রীজের নিচে বালি দেওয়া রাস্তা হেটে পার হলাম ।
আমরা সন্ধ্যা সাতটায় পৌঁচ্ছালাম একটা পাহাড়ি বাড়িতে । এতক্ষণে আমাদের গাইড সুদ্বীপ কোচ এর মুখ খুললো । আমরা এখন আন্ধারুপাড়ার খলচান্দা গ্রামের রাজেন চন্দ্র কোচের বাড়িতে । আমাদের থাকার জন্য দুটো ঘরের ব্যবস্থা করা হল । আমি, কাদের ভাই , সীমান্ত দা এক ঘরে । শশী, রিদিতি , সুখী, আইরিন , দিশা মিলে আটজন এক ঘরে ।আমাদের ঘরটার দেয়াল মাটির । সমন্বয়ক মাহিদ ভাই বলেছিলেন পাহাড়ে ভীষণ থাকবে-পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিও । ঘটনা সত্যি । যাই হোক, হাত মুখ ধুয়ে বাজার করতে বের হলাম , রাতের রান্না হবে না বাজার ছাড়া । কাজেই আবার বের হতে হলো ।
মাঝে পথে কাদের ভাই সিগারেট জ্বালালেন । নিকোটিন ছাড়া কাদের ভাইয়ের চলে না । তিনি নীরব প্রকৃতির মানুষ । লেখালেখিতে তার হাত ভালো । রাজনীতিতে নেমেছিলেন কিছুদিন; পরে অবশ্য ছেড়ে দেন । রাজনীতি কেন ছাড়লেন জিজ্ঞাসা করলেই বলেন-‘হালাগো কথা বাদ দাও।’ বলেই চুপ হয়ে যান । তখন সিগারেটে জোরে সোরে টান দেন । তারপর বলেন ‘বুঝলা জাফর, রাজনীতি বহুত প্যাঁচের জিনিস । একবার পড়ছো তো জীবন শেষ ।’ আমি শুধু জ্বী ভাই , হ্যাঁ ভাই বলে মাথা নাড়ি ।
বারোমারী বাজার বেশ বড় । আন্ধারুপাড়ার আন্ধার নেই এখানে । ঘুরে ঘুরে বাজারটা দেখলাম । বাজারের বিশেষত্ব এই যে, মুদির দোকানে পর্যাপ্ত পণ্য পাওয়া যায় ; তবে হ্যাঁ ,চিকিৎসার ঔষধ পত্রে অসুবিধা রয়েছে । হাতুড়ে ডাক্তারই এখানে একমাত্র ভরসা । মার্ক্স যে শ্রেণি সংগ্রামের কথা তাঁর ‘ক্যাপিটেল’-এ উল্লেখ করেছেন তার প্রমাণ দৃশ্যমান । বাজারের অধিকাংশ দোকানের মালিক বাঙালি, দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া । আদিবাসীদের স্থান কোথায়! আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, ডাল কিনলাম । মুরগির প্রতি কেজি ১৫০ টাকা করে প্রায় সাড়ে তিন কেজি মুরগি ৫২৫ টাকা ।
 জিলাপির প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে । খুঁজে পেলাম জিলাপির দোকান । রসে ডুবানো হচ্ছে জিলাপি । আহ কি স্বাদ! বাজারের একদিকে রসমালাই পাওয়া গেল, মনে হল মহাভারতের কথা শুধু নয়, রসমালাইয়ের স্বাদও অমৃত সমান ।

বাজার থেকে বের হলাম রাত নয়টার দিকে । আন্ধারুপাড়ার চৌরাস্তার মোড়ে তখন মিটমিট করে আলো জ্বলছে । আমাদের সঙ্গে কোচ পরিবারের আরও দুইজন রয়েছে । একজন রাজু অন্যজন প্রদীপ । চলতে চলতে প্রদীপ আমাদের খলচান্দা পাহাড়ের গল্প শোনালো । গল্পটি এমন-
একদিন এক কাঠুরে বনে কাঠ কাটতে গেল । সময় তখন দুপুর । কিছুক্ষণ কাঠ কাটার পর বিশ্রাম বোধ করল । বিশ্রাম শেষে আবার যেই মরা গাছে কোপ দিয়েছে- তখনই একটা জুতা এসে তাকে বেঘোর পেটাতে শুরু করল । কেউই নেই,শুধু জুতার মার খেয়ে সে ভয়ে দৌঁড় দিল । জুতা ও তার পিছু  পিছু ছুটল । বাড়ি ফিরে সেই কাঠুরের জ্বর দেখা দিল । জ্বর থেকে মুক্ত হওয়ার পর সে তার বউকে সব ঘটনা খুলে বলল । এরপর থেকে সে আর বনে কাঠ কাটতে যায়নি ।
রান্না শুরু হয়ে গেল । রিদিতি, আইরিন,সুখীরা রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে । রিদিতিকে কখনও এমন দেখিনি । মনে হল গৃহকর্ত্রী যেমন তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঠিক তেমন । খোলা চুলে মনে হল বাঙালি রমণীর চির শাশ্বত রূপ । সিতারাণী কোচের ছোট্ট হেঁশেল ঘর । তাতে আরও আট রাণীর জায়গা সংকুলান হল । কিছুক্ষণ আগে যে হিমা কথায় কথায় বলছিল-হাসিস নারে ভাই , হাসি দেখলে আমার বমি আসে । ভূতের গল্প শুনলে আমার বমি আসে । সে হিমা বেগুন পোড়াতে শুরু করল । রাতে সে বেগুন ভর্তা খাওয়াবে সবাই-
প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে যোড় হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান ।
দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান ।
ভারতচন্দ্রের দেবী,ঈশ্বরী পাটুনীকে বর দিয়েছিলেন দুধে ভাতের । কিন্তু ভর্তা-ভাতের বর কে দিল  বেগুন ভর্তার পর আলু ভর্তায় হাত দিয়েছে রিদিতি । ভর্তাময় জীবন!  মরিচ কাটতে দেখি ভালোই অভ্যস্ত দিশা । অনেক বেশি নীরব প্রকৃতির মেয়ে সে । অনেক ব্যাপারে হাসি দিয়েই চুপ থাকে ।
রাতের নির্জনতা ক্রমশ বাড়ছে । প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বারান্দায় দশ-বারো জন মিলে কোচ পরিবারের মহিলা পুরুষ ভারতীয় সিরিয়ালের মহাভারত পর্ব উপভোগ করছে । ধর্ম এখানে আনন্দ উপলক্ষ । বারান্দার উপরের দিকটায় মশাল । কেন এই মশাল ? এটি জীবন সংগ্রামের প্রতীক । পাশেই ভারত । ভারত থেকে দল বেঁধে হাতি আসে খলচান্দায় । তখন শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। বেঁচে থাকার সংগ্রাম । হাতি তাদের জীবন যন্ত্রণার অবিচ্ছেদ্য অংশ । ভাঙা-গড়ার ইতিহাস হাতিকে নিয়ে । কত নির্ঘুম রাত হয়ত জোছনায় , হয়ত বর্ষার কেটে যায়-হাতি পাহারায় ।
কিছুক্ষণ আগে রাতের খাবারের পর্ব শেষ হয়েছে । সবাই ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়েছে । ঘরে থেকে কাদের ভাই একা বের হলেন । হয়ত সিগারেট জ¦ালাবেন । আমিও বের হলাম । বাড়ির পশ্চিম দিকটার আম গাছের নিচে মাচায় বসলাম । সোলারের আলো (খলচান্দায় সৌর বিদ্যুৎ-ইএকমাত্র ভরসা ) নিভু নিভু জ্বলছে । ভারত সরকারের বদান্যতায় সীমাৗেল্প সার্চ-লাইট জ্বলছে । তাতেই আলোকিত হয়ে উঠেছে খলচান্দার মাঠ , চেল্লাখালির জলে দল বেঁধে ¯œান করে বেশ মজা পেয়েছি । যদিও তাতে জল বেশি নেই । এক হাটু জল মাত্র, এই শীতে!
রবীন্দ্রনাথের স্টাইলে কাদের ভাই বললেন,‘হিমা আমার কিনা ছিল ? কিনা হইতে পারে ? রাতে বারোটা পার হয়েছে মাত্র  । পাহাড় থেকে ভেসে আসছে ঢোলের শব্দ ।
মেঘালয় থেকে আসছে আতশবাজির শব্দ । বারমারী চার্চেও হয়ত যিশু’র প্রার্থনায় মগ্ন সবাই । বড় দিনের উৎসব শুরু হয়ে গেছে । হয়ত কীর্তনে গাওয়া হচ্ছে যিশু’র বন্দনা-
ওড়াও অভি জয় পতাকা
জয় যিশু বলে ।।
মঙ্গল আসে হেসে,হেসে ।।
সকল মিলে, সকলে মিলে...
পূর্ব দিক নতুন সূর্য উঠেছে
যদি তোমার দাও গো দেখা
মহাশান্তি,প্রেম প্রীতি মিলে।।
ওড়াও অভি, জয় পতাকা
জয় যিশু বলে, জয় যিশু বলে ।
ঘন জঙ্গলে ভিতর আমি এবং কাদের ভাই দাঁড়িয়ে আছি র্সাচ-লাইটের আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে । সম্মুখে কাঁটাতার পেরুতে ঝিঁঝিঁ পোকার পাসপোর্ট লাগে না , কিন্তু মানুষের লাগে । হায়! কাঁটাতার ।

 লেখক: জাফর জয়নাল   
jafourjkkniu@gmail.com





আমাদের ইউটিউব চ্যালেন সাবস্কাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7