আজ থেকে আট বছর আগে হিকমতের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। হিকমত কেমন আছে, আমি জানি না। আর জেনেই বা আমার লাভ কী ! আমার চারদিকে এখন রঙিন জগৎ । না চাইতে-জন্মদিন পার্টি, সভা-সেমিনারে যাওয়ার দাওয়াত পত্র এসে পড়ে । মাসের শেষে ব্যাংকে বেশ কিছু টাকা জমা পড়ে । যাকে বলে নিশ্চিত জীবন । আমি সেই জীবনে পেয়েছি- যেমনটা চেয়েছিলাম ।
গতকালকে হিকমতের মৃত্যুর খবর পেলাম । বড় মামা মোবাইলে বিষয়টা নিশ্চিত করলেন । খবর পেয়ে গ্রামে যাওয়া হল না ; যাওয়া হয় না বহুকাল । কি হবে গিয়ে!
হিকমতের গায়ের রঙ ছিল কুচকুচে কালো । যাকে বলে ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ । মাথা ভরা তার চুল ছিল তার চোখ ছিল উজ্জ্বল। অধিকাংশ সময় ওর চোখ লাল থাকত । শরীরে শক্তি ছিল বলার মত। দু’চার জনকে একা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল । আমি , আইরিন আর সে এক সঙ্গে স্কুলে যেতাম । আমরা যেবার ক্লাস এইটে উঠি সে-বার আইরিনকে নিয়ে হিকমত পালিয়ে গেল । আমি কিছু আঁচ করার আগেই ঘটলো এমন ।আইরিন দেখতে অসম্ভব রকমের সুন্দরী ছিল । লম্বা চুল ছিল তার । যখন স্কুলের পথে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসতাম , তখন আইরিনের চুল বাতাসে উড়ে আমার মুখে আছড়ে পড়ত । তখন কেমন যেন একটা অনুভূতি হত ! আজ এত বছর পর বুঝি সেই অনুভূতির মানে !
দুইদিন পর হিকমত আর আইরিনকে পাওয়া গেল হিকমতের মামা বাড়িতে । সেইদিনই বিকেলে গ্রামে বিচার বসল । সব বিচার বিশ্লেষণ শেষে রায় হল । যেহেতু আইরিনকে নিয়ে হিকমত তার মামার বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিল তাই সে অপরাধী । অপরাধী হিকমতকে বিশ জুতা মারা হলো আর এক হাজার টাকা জরিমানা করা হলো । হিকমতের বাবা হাফিজুদ্দি চাচা অপরাধী ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চললেন ।
কিছুদিন পর আইরিনের বিয়ে হয়ে গেল । সে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল যথারীতি । যেন কিছুই হয়নি এমনই একটা ভাব । নারী চিরকাল এমনি রহস্যময় । সপ্ত আশ্চর্যের এই জগতে সে অষ্টমাশ্চর্য ।
আইরিনের বিয়ে হয়ে গেল , কাজে সে আর স্কুলে যায় না। অন্যদিকে হিকমত গঞ্জে হাফিজুদ্দি চাচার দর্জি দোকানে আর একটা সেলাই মেশিন নিয়ে বসে পড়ল । আমি হয়ে গেলাম একা । একা স্কুল - কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় করতে করতে- একা চলাফেরা শিখে ফেললাম । মানুষ একা চলে আত্ম-আবিষ্কারের প্রয়োজনে আমিও তাই ।
কিছুদিন দর্জির কাজ করলেও, একদিন সবকিছু ছেড়ে হিকমত নিরুদ্দেশ হল । বছর চারেক পর ফিরল । তবে, আগের হিকমত নয় , অন্য হিকমত। সে হিকমতের হাতে দোতারা । সে গান বাঁধে-
‘‘আমার মনের ময়না রে তুমি কোথায় রইলা রে ।
সুখের ঘরে আগুন জ্বলে তুমি কোন ডালে বইলা রে । ’’
হিকমতের মনের ময়না; কেমন আছে আমি জানি না । ময়না নিশ্চয় মন্দ নেই । মন্দ থাকার সময় কই আমাদের !
আমাদের ইউটিউব চ্যালেন সাবস্কাইব করতে লিংক এ ক্লিক করুন
কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।