নকশী কাঁথায় পাল্টে গেছে রুনার জীবনের গল্পটা



চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম হস্তশিল্প, নকশী কাঁথা। নারীদের নিপুন হাতের ছোয়ায় প্রতিটি কাঁথায় যেন হয়ে উঠে একেকটি জীবনের গল্প। আর সেই কাঁথার প্রতিটি ফোড়েই যেন পাল্টে গেছে হতদরিদ্র নারী রুনা বেগমের জীবনের গল্প। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর পাশের গ্রাম গোহালবাড়ির রুনা বেগম এখন সফল উদ্যোক্তা, সৃষ্টি করেছেন অনেক নারীর কর্মসংস্থান। মহানন্দা নদীর খালঘাট এলাকা দিয়ে নৌকা দিয়ে নদী পার হলেই গোহালবাড়ি গ্রাম, খানিকটা পথ পেরুলেই রুনা বেগমের বাড়ি। পাকা বাড়ি, তবে একসময় অন্যের জমিতেই ছিলো রুনা বেগমের মাথা গোজার ঠায়। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, পরিপাটি গোছানো ঘরদোর, একটি ঘরে নকশী কাথা সাজানো আছে। বিকাল হতে না হতেই বেশ কয়েকজন নারী চলে এলেন সেখানে, এরপর নিজেদের মত করে বসে পড়লেন সেলাইয়ের কাজে। এই নারীরা সবাই রুনা বেগমের ‘আলেয়া নকশীর’ একেক জন কর্মী। বর্তমানে আলেয়ার নকশীতে কাজ করছেন ৪০ জন নারী কর্মী।
জীবনের বাঁকে বাঁকে বাঁধা পেরিয়ে আসা রুনা বেগম বলছিলেন, মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিলো তার, এরপর শ্বশুর বাড়িতে খুব বেশি দিন থাকা হয়নি, পরে অন্যের জমিতে ঘর তুলেন, কিন্তু কিছুদিনের মাথায় স্বামী আলমও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিভাবে করবেন স্বামীর চিকিৎসা, কিভাবে চলবে সংসার, এ চিন্তায় অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেন রুনা,  তিন বেলায় একবেলা জুটত খাবার। তখন অন্যের দেয়া কাঁথা সেলাই করতেন, এরপর নিজেই একদিন ৫০০টাকা খরচ করে পুরাতন কাপড় দিয়ে একটি কাঁথা তৈরী করলেন, আর ওই কাঁথা বিক্রি হলো দেড় হাজার টাকায়। তখন থেকেই যেন পাল্টে গেল রুনার চিন্তাভাবনা, নিজেই কাঁথা তৈরী শুরু করলেন। ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বাড়ায় যুক্ত করেছেন এলাকার অন্য নারীদের । তার এখানে যারা কাজ করেন তারা মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরী পেয়ে থাকেন। কর্মীদের বেতন, উপকরণ ক্রয় সবকিছু বাদ দিয়ে রুনা বেগমের মাসে লাভ হয় অন্তত ৪০-৫০ হাজার টাকা।
গ্রামের নারীরা অবসর সময়ে, আলেয়া নকশীতে কাজ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেয়ে অনেক খুশি, তাদেরই একজন সাবিত্রী রানী বলছিলেন, দুপুরে ঘরের কাজ শেষ হওয়ার পর বিকালে এখানে আসি, সেলাই করি, সবার সাথে গল্প করাও হয়, সেলাই করাও হয়। আবার মাস শেষে কিছু টাকাও পায়, এতে সংসারের কাজে লাগে।
একসময় অন্যের জমিতে থাকলেও বর্তমানে রুনা বেগমের ৭ কাঠা জমি, স্বামিকে কিনে দিয়েছেন অটোরিক্সা, বাড়িতে একটি গরুও পালেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেটা নবম শ্রেনীতে পড়ে।
কথা বলতে বলতে অনেকটা কষ্ট নিয়েই বলে উঠেন রুনা তার এ কাজে গ্রামের অনেকেই মন্দ কথা বলেছেন, তার স্বামীকেও অনেকে ভুল বুঝিয়েছেন। এ নিয়ে সংসারে কিছুটা ঝামেলাও হয়েছে, তবে এসব কথাকে তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে গেছেন তিনি।
রুনা বেগম দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলায় অংশ নিয়ে তার পন্য বিক্রি করেন, এছাড়াও ঢাকায় তার রয়েছে নির্ধারিত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান যাদের কাছেও নকশী কাথা সরবরাহ করে থাকেন। এছাড়াও নিয়ে জাপান নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশেও নিয়ে গেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশী কাঁথা। একাজের স্বিকৃতিও মিলেছে অনেক, জয়ীতার পুরস্কার,তাকে এখন অনেকেই চিনে।
রুনা বেগমের এগিয়ে যাওয়ার গল্পটা সম্পর্কে জানেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাংলা বিভাগের প্রধান ও লোকশিল্প গবেষক ড. মজহারুল ইসলাম তরু। তিনি বলেন, সমাজে নারীদের এগিয়ে চলায় অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে, তারপরও সেসব বাঁধা পেরিয়ে রুনা নিজেকে স্বাবলম্বী করেছে, শুধু সে নিজের ভাগ্যই বদলায়ই অন্তত ৪০ নারীর সে কর্মসংস্থাও সৃষ্টি করেছে। নারীর ক্ষমতায়নের উদহারণ হতে পারে এ রুনা। আর সবচেয়ে বড় বিষয় যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশী কাঁথাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি দেশের বাইরেও বিক্রি করছে, এ মাধ্যমে সে জেলাকেও ব্যান্ডিং করছে।
জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সাহিদা আখতার বলেন, রুনা বেগম অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারী হিসাবে জয়ীতার খেতাব পেয়েছেন, আমরা চাই পিছিয়ে পড়া নারীরা স্বাবলম্বী হোক। এজন্য বর্তমান সরকার নারীদের কর্মমূখী প্রশিক্ষনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে।




কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7