মহুয়ার ট্র্যাজেডি : জীবনে ও শিল্পে

 হাতেতে আছিল মোর
বিষলক্ষের ছুরি।
তোমারে ছাড়িয়া বন্ধু
আমার বুকে মারি।
            -দ্বিজ কানাই

১.
কবি নমশূদ্রের ব্রাহ্মণ দ্বিজ কানাই প্রায় ৪০০ বছর আগে এই পালা (দৃশ্যকাব্য) রচনা করেন। এই পালার কেন্দ্রীয় চরিত্র মহুয়া এবং নদের চান। মহুয়া কাঞ্চনপুর গ্রামের মেয়ে। হুমরা বেদে যে প্রথম জীবনে ডাকাত ছিল, সেই বেদে মহুয়াকে ছয় মাস বয়সে চুরি করে নিয়ে আসে- এর ভেতর দিয়ে মহুয়ার জীবনে ট্র্যাজেডির শুরু। এক দুই তিন করে ষোল বছর হলো মহুয়ার বয়স। এর মধ্যে বেদে মেয়ের মতো সে নাচ-গান এবং বাজী দেখানোর কৌশল আওতায় করে নিয়েছে। বেদে সমাজে সে অতি সুন্দরী হিসেবে স্বীকৃত। হুমরা ছোট ভাই মানইকার সাথে পরামর্শ করে গারো পাহাড় থেকে বিদেশের দিকে যাত্রা করে। সেই যাত্রায় মহুয়া এবং তার পালঙ্ক সই। তারা বামনকান্দা নামক একটি গ্রামে উপস্থিত হলো। সেই গ্রামের ব্রাহ্মণ পুত্র নদের চান। বেদে সম্প্রদায়ের তামশা দেখতে গিয়ে মহুয়া সুন্দরীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে নদের চান। তাদের প্রেমকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেই না হুমরা বেদ। ফলে মহুয়াকে নিয়ে রাতের আঁধারে বেদের দল পালিয়ে যায়। মহুয়ার খোঁজে নদের চান বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রায় এক বছর সন্ধান করার পর নদের চান খুঁজে পায় মহুয়াকে। হুমরা বেদে নদের চানকে হত্যার জন্য মহুয়াকে প্ররোচিত করে এবং বিষ মেশানো ছুরি দেয়। মহুয়া নদের চানকে হত্যা না করে দুজন সেই রাতেই পালিয়ে যায়। ঘন বনের ভেতর দিয়ে ঘোড়া চড়ে পালায় দুজন। নদী পার হওয়ার জন্য সওদাগরের সাহায্য প্রার্থনা। নদের চান ছাড়াই মহুয়াকে নিয়ে সওদাগরের ডিঙ্গা নিয়ে যাত্রা। মহুয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেই সওদাগর। খাবারে বিষ মিশিয়ে সকল মাঝিমাল্লাসহ নৌকা ডুবানো এবং তীরে ফিরে আসে মহুয়া। বনের ভেতর নদের চানকে খোঁজা। অনেক খোঁজার পর প্রাচীন মন্দিরের নিকট নদের চানের সন্ধান পায় মহুয়া। সন্ন্যাসীর কুপ্রস্তাব  পেয়ে রাতের আঁধারে মহুয়া অসুস্থ নদের চানকে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে নদীর তীরে দুজন এক সাথে বসবাস আরম্ভ করে। কিন্তু কিছুদিন পর হুমরা বেদের আগমন ঘটে তাদের এই আবাসস্থলে। আবার মহুয়াকে ছুরি দেয়া হয় নদের চানকে হত্যা করার জন্য। এবং হুমরার পালক পুত্রকে বিয়ে করতে বলা হয়। কিন্তু মহুয়া রাজি হয় না। মহুয়া সবার সামনে ছুরি দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। হুমরা বেদের নির্দেশে নদের চানকে হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময় হুমরা তার ভুল বুঝতে পারে। এবং সে বনে একা থাকতে চায়। মহুয়ার কবরের কাছে তার পালঙ্ক সই থেকে যায়। এইভাবে বিয়োগাত্মকভাবে সমাপ্তি ঘটে মহুয়া দৃশ্যকাব্যের।

২.
এখন আসি আমার দ্বিতীয় প্রস্তাব প্রসঙ্গে। এই কাব্যটি একটি ট্র্যাজেডিক কাব্য। সেই ট্র্যাজেডি একভাবে ‘মহুয়ার ট্র্যাজেডি’। যে সমস্ত গুণ থাকলে তাকে ট্র্যাজেডি বলা হয়, তার বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্য এই পালায় উপস্থিত রয়েছে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডি সম্পর্কে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন-
‘ট্র্যাজেডি হলো একটি গম্ভীর, সম্পূর্ণ ও বিশেষ আয়তনবিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুকরণ, ভাষার সৌন্দর্যে তার প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র, এই ক্রিয়াটির প্রকাশরীতি বর্ণনাত্মক নয়, নাটকীয়, আর এই ভীতি ও করুণার উদ্রেক করে এবং তার মধ্য দিয়ে অনুরূপ অনুভূতিগুলোর পরিশুদ্ধি ঘটায়।’ [কাব্যতত্ত্ব : অ্যারিস্টটল, অনুবাদ : শিশির কুমার দাশ, প্যাপিরাস, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, প্রথম প্যাপিরাস, সংস্করণ ১৯৮৬, পৃ. ১৫]
ট্র্যাজেডি শব্দের অর্থ দুঃখজনক ঘটনা। ট্র্যাজেডির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন-
ক. ট্র্যাজেডি ‘সিরিয়াস’ বা গুরুগম্ভীর ঘটনার অনুকরণ। গুরুগম্ভীর বলতে বোঝায় জীবনের উপরিতলের কোনো তরল, লঘু, কৌতুকজনক ঘটনা ট্র্যাজেডির বিষয়বস্তু হবে না। মানব-অস্তিত্বের গভীর কোনো সংঘাত, যা বহির্জীবনে; ঔচিত্যবোধের ও নৈতিকতা সংঘর্ষ; ভাগ্যের প্রতিকূলতায় মানুষের শোকাবহ পরিণাম- এসব নিয়েই ট্র্যাজেডি নির্মিত হবে।
সে দিক দিয়ে মহুয়া পালাটিতে মহুয়ার জীবনে ধেয়ে আসা পালকপিতা এবং প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করার মতো মানব ভয়াবহ টানাপোড়নের বয়ান এই পালা। ট্র্যাজেডিতে সর্বদাই মৃত্যুই পরিণাম হবে এমন না হলেও, এটি ট্র্যাজেডির অন্যতম শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য। জীবনের অন্তর্গত বিপন্নতার রূপায়ণ থাকে বলেই ট্র্যাজেডির বিষয়বস্তু হবে গুরুগম্ভীর। আমরা মহুয়া এবং নদের চানের করুণ পরিণতি দেখি- আত্মহত্যা এবং হত্যা। কালজয়ী নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ‘রোমিও জুলিয়েটে’ তিনটি চরিত্রের করুণ পরিণতি আমাদের ট্র্যাজেডি বৈশিষ্ট্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।
খ. অ্যারিস্টটল বলেছেন, ট্র্যাজেডির ঘটনা হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নির্দিষ্ট  আয়তনবিশিষ্ট। নির্দিষ্ট  আয়তন বলতে অ্যারিস্টটল বুঝিয়েছেন যে, ট্র্যাজেডির বিস্তার এত বড় হবে না যে তা দর্শক-পাঠকের স্মৃতিতে একত্রে বিধৃত থাকতে পারবে না। এর মানে ট্র্যাজেডি হবে নাতিদীর্ঘ। মহুয়া পালায় মোট ২৪টি অঙ্কে বিভক্ত হলেও তা নাতিদীর্ঘ একটি পালা।
গ. ট্র্যাজেডির রচনারীতি বিবৃতিমূলক নয়, এই রচনারীতি ক্রিয়াত্মক বা নাটকীয়। মহুয়া পালার ভাষা এবং রচনারীতি পরিমিত ঘরানার। যেমন মহুয়ার মোট ছত্র ৯৮৬টি।

                                  “বাড়ী ঘর পড়্যা থাকুক সাইলের চিঁড়া।
                             এই দেশেতে না থাক্য ভাইরে আমার মাথার কিরা।”

ঘ. অ্যারিস্টটল বলেছেন, ট্র্যাজেডিতে থাকবে ভাষার সৌন্দর্য এবং প্রতিটি অঙ্গ অনুভূত হবে স্বতন্ত্রভাবে। তিনি কেবল ‘প্রতিটি অঙ্গ’- এই অভিব্যক্তির মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ট্র্যাজেডিতে থাকবে বিভিন্ন অঙ্গ। ভাষার সৌন্দর্য বলতে অ্যারিস্টটল সুচিন্তিত এবং সুনির্মিত বাক্য, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। মহুয়া পালার প্রতিটি বাক্য সুনির্মিত বাক্যময়তায় ভরা, প্রতিটি ছত্রই সংগীত হিসেবে গীত হয় অভিনয়ের সময়।
“কঠিন তোমার মাতাপিতা কঠিন তোমার হিয়া।
এমন যইবন কালে নাহি দিছে বিয়া।।”
“কঠিন আমার মাতাপিতা কঠিন আমার হিয়া।
তোমার মত নারী পাইলে করি আমি বিয়া।।”
“লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জ নাইরে তর।
গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুব্যা নর।।”
“কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ি।
তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি।।”

ঙ. ট্র্যাজেডির পরিণামে দর্শক এবং পাঠকের চিত্তে জাগবে করুণা এবং ভয়। ট্র্যাজিক কাহিনীর অন্যতম আবশ্যিক লক্ষণ হলো এই করুণা ও ভয় উদ্রেক করবার সামর্থ্য। মহুয়ায় এই ক্লাইমেক্স উপস্থিত। মহুয়ার ছুরি হাতে নিয়ে থাকার প্রতিটি ছত্রই ক্লাইমেক্স তৈরি করেছে। পালঙ্ক সইয়ের বাঁশির সুর ক্লাইমেক্সগুলির ভেতর অন্যতম।
“দূর বনে বাজল বাঁশী শুন্যাছ যে কানে।
আসিছে বাদ্যার দল বধিতে পরাণে।
আমারও পালং সই বাঁশী বাজাইল।
সামাল করিতে পরাণ ইসারায় কহিল।।”

চ. ট্র্যাজেডির সংজ্ঞায় অ্যারিস্টটল ‘ক্যাথারসিস’ শব্দটির উল্লেখ করেছেন। ‘ক্যাথারসিস’ শব্দটিকে বাংলায় অনেকে ‘ভাবমোক্ষণ’ বলে থাকেন।
মহুয়ায় এই ‘ভাবমোক্ষণ’-এর উপস্থিত আমরা সর্বশেষ দেখতে পায় প্রতিটি চরিত্রের প্রতি দর্শক-শ্রোতার ভালোবাসার দিক দিয়ে।
সাধারণভাবে বলা যায়, ট্র্যাজেডি দর্শক  ও পাঠকের চিত্তে করুণা ও ভয়ের উপলব্ধির সাযুজ্যমূলক প্রতিক্রিয়া জাগ্রত করবে- এখানেই ট্র্যাজেডির শিল্পোত্তীর্ণতা। মহুয়াকে আমরা তাই দ্বিজ কানাই’য়ের সার্থক ট্র্যাজেডি বলতে পারি কোনো সংকোচ ছাড়াই।


তথ্যসূত্র
১. মৈমনসিংহ-গীতিকা : শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন; গতিধারা
২. পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ধ্রুপদী ও আধুনিক : হাবিব আর রহমান; কথা প্রকাশ
৩. মৈমনসিংহ গীতিকা : শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন; সৈয়দ আজিজুল হক (সম্পাদিত); মাওলা ব্রাদার্স

জাফর জয়নাল, শিক্ষার্থী, ফোকলোর বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।


কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7