বীরকন্যা প্রীতিলতার ৮৬তম আত্মাহুতি দিবস

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন

আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৮৬তম আত্মাহুতি দিবস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এই দিনে বিপ্লবী বীরকন্যা প্রীতিলতা চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমণে বিপ্লবী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে অনন্য এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন; যা আজো মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার  উৎস হয়ে আছে। 
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়ে ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করতেন। ছেলেবেলা থেকে মেধাবী প্রীতিলতা পড়ালেখার পাশাপাশি নানা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি  দীপালি সংঘের মতো প্রগতিশীল সংঘের সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে খুব সহজে লীলা নাগের মতো বিপ্লবী নারীর সংস্পর্শে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রীতিলতা ভাবতেন, ১৭৫৭ সালে রাণী ভবানী আর তারও শত বছর পর ঝাঁসির রানী লক্ষ¥ীবাই যদি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়তে পারেন, তাহলে তিনি কেন পারবেন না? কেন তিনি মাতৃভূমির এমন সংকটপূর্ণ সময়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন?  কিন্তু সে সময় বিপ্লবী দলে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না। নারীরা কেবল বিপ্লবীদের গোপনে অর্থ, খাদ্য, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করতেন। তবে  প্রীতিলতা এ আগর ভাঙতে চেয়েছিলেন। নানা চেষ্টায় তিনি  বিপ্লবীদলের নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হন এবং নানা বিপ্লবী কর্মকা-ের মাধ্যমে সূর্যসেনের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। ফলশ্রুতিতে নারী হয়েও চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের মতো একটি দুঃসাহসিক অভিযানের নেতৃত্বের দায়িত্ব পান। নারী হয়ে এমন দায়িত্ব পাওয়া ছিল সে সময় অকল্পনীয়। কিন্তু তিনি অসম সাহসিকতায় সেই দায়িত্ব পালন করে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ পরাধীন দেশের মানুষকে করেছে গৌরবান্বিত, করেছে অনুপ্রাণিত। এছাড়াও পেছনে থাকা নারীকে করেছে সম্মানিত। কেননা তিনিই হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম নারী শহীদ।
“ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না”- গোটা দুনিয়ার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে উপনিবেশ কায়েমকারী বর্বর ব্রিটিশ এই দম্ভে ছিল অন্ধ। চট্রগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবের প্রবেশদ্বারে লেখা, “ভারতীয় আর কুকুরদের প্রবেশ নিষেধ”। এটি ব্রিটিশ বেনিয়াদের যেমন দাম্ভিকতার একটি রূপ, তেমনি এ দেশের মানুষের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ। তাদের এই দাম্ভিকতা ও ঘৃণার দাঁত ভাঙা পাল্টা জবাব দিতেই এই ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন বিপ্লবীরা। এই ক্লাবেই বসত ইংরেজদের সান্ধ্যকালীন আনন্দ-আড্ডা। প্রীতিলতা মনে করতেন, পরাধীন মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে ছেলেরা যদি সশস্ত্র সংগ্রাম করতে পারে, প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে তাহলে মেয়েরা কেন পিছিয়ে থাকবে? একজন নারী হওয়ার কারণে দেশমাতৃকার এমন দুর্যোগপূর্ণ দিনে কিছুতেই প্রীতিলতা ঘরে বসে থাকতে পারেননি। প্রীতিলতা মৃত্যুর আগে লিখে গেছেন, “দেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না?” মৃত্যুর আগে লেখা প্রীতির কথা থেকে বোঝা যায়, সংগ্রামে অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্য মেনে নিতে পারেননি তিনি। আর তাই শত বাধা ডিঙিয়ে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। মাস্টারদা সূর্যসেনের সাহচর্যে এসে তিনি নিজেকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য তৈরিও  করেন। তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের জাঁতাকলে মানুষের জীবন বিপন্ন। আর তাই এই নিপীড়িত শোষিত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেছেন তিনি।
মৃত্যুর পর প্রীতিলতার দেহ তল্লাশি করে প্রীতিলতার স্বহস্তে লিখিত একটি বিবৃতি পাওয়া যায় । তাতে লেখা ছিল, “আমি স্বদেশ জননীর চোখের জল মুছাইবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ। ... বৃটিশ জোরপূর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ... সুতরাং তাহারাই আমাদের একমাত্র শত্রু। স্বাধীনতা লাভ করিবার পথে তাহারাই আমাদের আমাদের একমাত্র অন্তরায়। ... মুক্তিপথের যেকোন বাধা বা অন্তরায় যে কোন উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ... নারীরা আজ কঠোর সংকল্প লইয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবে না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সমস্ত বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন এই আশা লইয়া আমি আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।”
আজ থেকে ৮৬ বছর আগে প্রীতিলতা দেশকে সা¤্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য  নারীর খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আত্মদানের মাধ্যমে প্রমাণ করে গেছেন, পুরুষের পাশাপাশি নারী তার শক্তি, সাহস আর বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে অসাধ্য সাধন করতে পারে। প্রীতিলতা বাঙালি নারীসমাজকে রাজনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। করেছেন  নারীসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। পরবর্তীকালে প্রীতিলতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অসংখ্য নারী  স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীদেরও প্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি। কিন্তু এই বীর নারীর আত্মত্যাগের কাহিনী দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার মতো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আর নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি অজানাই রয়েছেন।
আজ সময় এসেছে প্রীতিলতার আদর্শকে ধারণ করার। নারীর অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সব ধরনের অনাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মন্ত্র নিতে হবে তাঁর কাছ থেকে। তাঁর আত্মাহুতি দিবসে জাগো নারী বহ্নিশিখার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

মনোয়ারা খাতুন : সদস্য সচিব, জাগো নারী বহ্নিশিখা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ






কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7