২৬ বছর ধরেই মানুষের পাশে

সৎ জনপ্রতিনিধির অনন্য দৃষ্টান্ত আরমানী বেগম

সততার অনন্য দৃষ্টান্ত জনপ্রতিনিধি আরমানী বেগম। টানা পাঁচ-পাঁচবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। অথচ নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও ঠিকমত করতে পারেননি। আড়াই শতকের বসতবাড়িতে কোনোরকমে টিনের চালা তুলে মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়েই দিনাতিপাত করছেন। রাত-বিরাত মানুষের ডাকে ছুটে যাচ্ছেন। অথচ ২৬ বছরে নিজের জন্য কত কিছুই না করা সম্ভব ছিল! কিন্তু সেসবের ধারেকাছে যাননি। ‘অভাবী’ জনপ্রতিনিধির প্রাপ্তি এটুকুই, দুই সন্তানের মধ্যে ছোটটিকে ¯স্নাতকোত্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। আরমানী বেগম, একটি নাম; নামটিই যার এখন প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে ২য় বার হ্যাট্রিক করবেন তিনি। পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্ব আরমানী বেগমের কাছে হ্যাট্রিক বড় কথা নয়; বয়স যতই হউক যতদিন সুস্থ থাকবেন ততদিনই তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে থাকতে চান। অবশ্য সাধারণ মানুষ যদি তাকে চান, তবেই। এও সত্য যে, আজ যেটুকুই হতে পেরেছেন তা মানুষের অকৃপণ সাহায্য-সহযোগিতার কারণেই- এ কথা জানাতেও দ্বিধা করেননি তিনি।   ব্যক্তিক কিংবা সাংসারিক জীবনে উন্নতি করতে না পারলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে সফল আরমানী বেগমের গল্পটা একটু আলাদা। সিরাজউদ্দিন মন্ডলের চার সন্তানের মধ্যে আরমানী ছিলেন একমাত্র মেয়ে। পড়াশোনা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। ২০ বছর বয়সে বাবা বিয়ে দেন। বিয়ের পর সংসারে অভাব-অনটনের দরুন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় বিক্রি শুরু করেন। সংসারে সচ্ছলতার জন্য জনপ্রতিনিধির পাশাপশি কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে গেছেন ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নাচোল পৌরসভা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত।
কাপড় বিক্রি শুরুর সময় মানুষ তাকে দু’হাত খুলে সহযোগিতা করেছেন। কেউবা চাল, কেউবা ডাল, কেউবা বাগানের সবজি তুলে তাকে দিয়েছেন। সেসব কথা আজও কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করেন তিনি। আরমানী বেগমের বক্তব্য, মানুষ যদি তাকে সাহায্য-সহযোগিতা না করত তবে আজকের আরমানী বেগম তিনি হতেই পারতেন না।
কাপড় বিক্রির সময় থেকে জড়িত হন বিআরডিপির সমিতির সঙ্গে। সমিতির ম্যানেজারও হন। এটা ১৯৮১-৮২ সালের দিকের ঘটনা। সমিতি করার সময়ই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দাঁড়ানোর চিন্তাভাবনা তার। সে ভাবনা থেকেই ১৯৮৩ সালে প্রথম ৩নং নাচোল সদর ইউনিয়নের মেম্বার পদে প্রার্থী হন। ওই সময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন না থাকায় সরাসরি পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছিল তাকে। মাত্র ৪ ভোটের কারণে বিজয় ফসকে যায়। হাল না ছেড়ে ১৯৮৮ সালে আবারও নির্বাচনে দাঁড়ান তিনি। আবারও পরাজিত। তবুও হাল ছাড়েননি দৃঢ়চিত্তের আরমানী বেগম। এদিকে প্রথম স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে আবদুর রাজ্জাককে বিয়ে করেন। পরবর্তী সংসারেও ‘অভাব’ তার পিছু ছাড়েনি। অগত্যা কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া।
দুই-দুইবার পরাজয়ের পর আরমানী বেগম সফলতা পান ১৯৯২ সালে। সেবারই প্রথম ১০ ভোটের মধ্যে ৪ ভোট পেয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন তিনি। তার অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩ ভোট করে। [উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন নির্বাচিত মেম্বার ও চেয়ারম্যানের ভোটে।] নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলে কী হবে! মাসে সম্মানী হিসেবে পেতেন মাত্র ৪০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে তো আর সংসার চলে না। তাই কাপড়ের ব্যবসাটা ছাড়তে পারেননি। দায়িত্বও বেড়ে যায় অনেক। একদিকে সংসার সামলানো, অন্যদিকে কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া তার ওপর আবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা। সুনিপুণ দক্ষতায় তিনটি কাজই সামলেছেন তিনি।
১৯৯৭ সালের নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীর চেয়েও রেকর্ড ভোট পেয়ে মেম্বার নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে নির্বাচিত হয়ে হ্যাট্রিক করেন। ২০০৪ সালে পৌরসভা স্থাপনের পর আরমানী বেগম সেখানে কাউন্সিলর হিসেবে মনোনীত হন। মনোনীত হিসেবে পাঁচ বছর থাকার পর ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে সংরক্ষিত ৩ আসনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালে পৌর নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে টানা পাঁচবার জয়ের রেকর্ড করেন। সর্বশেষ নির্বাচন নিয়ে আরমানী বেগমের হতাশা আছে; তাহলো, অতীতের সব নির্বাচনে সব কেন্দ্রে প্রথম হলেও এবারই একটি কেন্দ্রে দ্বিতীয় হন; যা তার জীবনের দুঃখজনক ঘটনাই বটে।
টানা পাঁচ-পাঁচবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে চেয়ারম্যান-মেয়র হিসেবে যাদের পেয়েছেন, তাদের মধ্যে বর্তমান পৌর মেয়র আবদুর রশিদ খান ঝালুর সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগছে বলে জানান তিনি। দুই সন্তানের জননী আরমানী বেগমের বড় সন্তানের লেখাপড়া বেশিদূর নয়। বিয়ে-থা করে আলাদা থাকে। ছোট সন্তান আবদুল আলীমকে অনেক কষ্টেসৃষ্টে লেখাপড়া করিয়েছেন। নবারগঞ্জ সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি করলেও অর্থাভাবে সেখান থেকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে নিয়ে ভর্তি করেন নাচোল কলেজে। এখানে বি.কম পাস করার পর রাজশাহী কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স। ছেলে আবদুল আলীমও মায়ের জন্য গর্ববোধ করেন। তার কথা, ‘মা ২৬ বছর ধরে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসারের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেননি। এমনকি বাড়িটুকুও। কিন্তু মা আমাকে যতটুকু লেখাপড়া করিয়েছেন তা সচরাচর সবার ভাগ্যে জুটে না।’
আরমানী বেগম ২৬ বছরে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন অফুরন্ত। সুখে-দুঃখে মানুষের পাশেই থাকার চেষ্টা করেছেন। মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রাস্তাঘাট ও কালভার্ট নির্মাণ, টিউবওয়েল স্থাপনসহ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা যথার্থভাবে প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। মানুষের ভালোবাসয় টিকে আছেন তিনি। আর নিজের জীবনের প্রাপ্তি বলতে ছেলেকে পৌরসভায় অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছেন।
আরমানী বেগম সম্পর্কে নাচোল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ওবাইদুর রহমানের মূল্যায়ন, ‘সৎ জনপ্রতিনিধির অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। একজন নির্লোভী মানুষ এবং মানুষের সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করেন। লেখাপড়া বেশিদূর না করলেও তার সততার জন্য মানুষ তাকে বারবার নির্বাচিত করে।’
বর্তমান নাচোল পৌর মেয়র আবদুর রশিদ খান ঝালু আরমানী বেগম সম্পর্কে বলেন, ‘সাদাসিধে মানুষ বলতে যা বোঝায়, আরমানী বেগম তাই। প্রচ- সৎ এবং এজন্য তিনি ব্যক্তিজীবনে সেরকম কিছু করতে পারেননি। আজও প্রচ- টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করেন। কখনো কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করেননি। সর্বদাই উপকার চেষ্টা করেছেন বলেই মানুষ তাকে টানা পাঁচবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছেন।’
আরমানী বেগমের দুঃখ, টানা পাঁচবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও কোনো স্বীকৃতি তিনি পাননি। সারাজীবনই সততার সঙ্গে কাজ করে এসেছেন। বড় কষ্টের বিষয়, চলতি ডিসেম্বরে তার ছোট ছেলের চাকরির বয়স শেষ হচ্ছে, এই সময়টুকুর মধ্যে যদি তার ছেলের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা হতো তবে মা হিসেবে তিনি সার্থক হতে পারতেন। সরকারের কাছে এ প্রত্যাশা রেখে আজও পথ চলছেন আরমানী বেগম।



#  সাজিদ তৌহিদ, প্রধান সমন্বয়ক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিভি.কম





About chapainawabganj tv

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7