২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মাটির বেদীর উপর বাঁশ-কঞ্চি দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের বাবুডাইং আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এবারের আয়োজনে তাদের আনন্দের মাত্রা ছিল অন্যরকম। কেননা এ দিন তাদের সঙ্গে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে বুনো ফুল হাতে হাজির হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের (আইরল্যান্ড) নাগরিক (আইরিশ) রোজ কেইন। তিনি তিন দিনের বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে এ বিদ্যালয়ে আসেন।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা কয়েক দিন আগে থেকেই মাটি দিয়ে শহীদ মিনারের বেদী তৈরি করে। এরপর সেখানে বাঁশ-কঞ্চি দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে। শহীদ মিনার রঙ করে ফুল দিয়ে সাজায়। মাটির বেদীতে মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকে আলপনা। এছাড়া মাটির শ্রেণিকক্ষগুলোর দেয়ালও লেপেপুছে ঝকঝকে-তকতকে করে সেখানে আলপনা আঁকে তারা। একুশের দিন সকালেই হাতে হাতে বুনো ফুল নিয়ে বরেন্দ্রভুমি উঁচুনিচু জমির আলপথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ের মাঠে এসে জড়ো হয় সকল শিক্ষার্থী। এরপর গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে কোল ও বাংলা ভাষায় একুশের গান গেয়ে প্রভাতফেরি অংশ নেয় তারা। এতে অংশ নেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরাও। প্রভাতফেরিতে ‘ইংবেন বয়হাওয়া রাগোয়া ইকুশ না: ফেব্রুয়ারি, ইংকি আত হিরিং ইং’.... অর্থাৎ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি.....’ কোল ও বাংলা ভাষায় একুশের গানটি সকলে গায়। প্রভাতফেরি শেষে নিজেদের বানানো শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর কোল ভাষায় গান গেয়ে মাদলের তালে নাচ করে কোল সাংস্কৃতিক দল। মাতৃভাষার সংগ্রাম, আত্মবলিদান ও তাৎপর্য নিয়ে হয় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। এরপর রচনা ও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এ আয়োজনে সহযোগিতা করে কোল ভাষা নিয়ে কাজ করা সামার ইনস্টিটিউট অব লিংগুইস্টিক (এসআইএল) ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বাড়ি বাড়ি থেকে তোলা চাল-ডাল দিয়ে রান্না খিচুরি খাওয়ানো হয় সকলকে।
চিত্রাংকন ও রচনা প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি জহিরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ও গ্রাম্য মোড়ল কার্তিক কোল টুডু, মাধব কোল সরেন, কোল নারী নেত্রী কল্পনা মুর্মু, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার উপদেষ্টা মতিউর রহমান, রফিক হাসান, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী উজ্জামান নূর। ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি করে নাবিহা আহমদে, আলী আসগার। কোল মাতৃভাষায় নাচ-গান পরিবেশন করে বিদ্যালয়ের কোল সাংস্কৃতিক দল। শেষে রচনা ও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
বিদেশী পর্যটক রোজ কেইন বলেন, আমি যুক্তরাজ্যের নাগরিক। কিন্তু আমি একজন আইরিশ। ইংরেজি ভাষায় কথা বললেও আমাদেরও নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এ বিদ্যালয়ের এ আয়োজন দেখে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা দেখে আমি আপ্লুত। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের তৈরি শহীদ মিনার ও বিদ্যালয়ের মাটির দেয়ালে আঁকা আলপনা দেখে আমি অভিভূত। এ দিনটির কথা আমার মনে থাকবে। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার সামগ্রী উপহার দেন।
গ্রাম্য মোড়ল কার্তিক কোল টুডু বলেন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রতিবছরই আমি এ অনুষ্ঠানে আসি। সব অনুষ্ঠান থেকে এটাকে আমার আলাদা মনে হয়। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। আমার কোল ভাষায় গান হয়, নাচ হয়। দেখে মন ভরে যায়।
বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শান্তি হাসদা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলে, আমরা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি। এজন্য আমরা বিদ্যালয়ের মাটির শ্রেণিকক্ষের দেয়াল লেপে-পুছে তাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে আলপনা আঁকি। মাটির বেদীতে বাঁশ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে শিক্ষার্থীরা। রং ও ফুল দিয়ে তা সাজানো হয়। মাটির বেদীতে আমরা আলপনা আঁকি। নিজেদের ভাষায় নাচ-গান করি। আমাদের খুব ভালো লাগে।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
0 Comments:
Post a Comment