১৯৬০ এর শেষে এবং ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে, একদল ফোকলোরবিদের তৎপরতায় আমেরিকান ফোকলোর সোসাইটির একটি অংশ হিসেবে প্রায়োগিক ফোকলোর গঠিত হয়। এর ভিতর দিয়ে তত্ত্ব, কৌশল এবং পদ্ধতির নতুন গঠনের ধারণার সূত্রপাত হয়। প্রায়োগিক নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে, এটি একটি ব্যাপক সংখ্যক প্রায়োগিক ফোকলোর শাখার বিশেষজ্ঞের কাজের ভিতর দিয়ে প্রায়োগিক ফোকলোরের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়; যেটি একই সঙ্গে পর্যাপ্ত কাজের উদাহরণ হিসেবে উপস্থিত হয় আমাদের সামনে। ১৯৭১ এর লোকসংস্কৃতি নিয়ে মধ্য আটলান্টিকের পিটসবার্গে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত ছিল, যার মূল প্রতিপাদ ছিল ‘প্রায়োগিক ফোকলোর’। নিচের এই সংজ্ঞাটি সেই আলোচনাসভায় ব্যবহার করা হয়েছিল- ‘‘... তাত্ত্বিক ধারণা, বাস্তবিক জ্ঞান এবং ফোকলোরের গবেষণার পদ্ধতি এবং কার্যক্রমের প্রধান কাজ হবে, এগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহারের ভিতর দিয়ে সমসাময়িক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সমস্যাগুচ্ছ সমাধান কার্যের যথাযথ উন্নয়নসাধন করা।’’ এই সংজ্ঞা প্রত্যক্ষভাবে পরিবর্তনের কথা বলে, অন্যদিকে পরোক্ষভাবে ফোকলোরবিদরা কাজ করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনানয়নের ক্ষেত্রগুলোর লালনপালনের।
পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে প্রায়োগিক ফোকলোর এর সংজ্ঞার ভিতর একধরনের পক্ষপাতদুষ্টতা রয়েছে। উদাহরণের জন্য বলা যায়, কে চিহ্নিত করবে যে, কোনটি ‘‘সমসাময়িক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সমস্যাগুচ্ছ?’’ আরও একটু যোগ করে বলা যায় যে, এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে কোনটি আসলে জনগোষ্ঠী জীবন, প্রতিষ্ঠান এবং অবকাঠামোর ভিতর সঠিকভাবে এবং সমানভাবে কাজ করবে, এই সিদ্ধান্ত তৈরি এবং বাস্তবায়ন আমাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
১৯৭১ সালে যখন লোকসংস্কৃতির ওপর আলোচনা সভাটি চলছিল, সেই সময়- রিচার্ড বাউম্যান প্রায়োগিক ফোকলোরের জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। যদিও সেই সভায় ফেকালোরবিদরা ছোট করতালির মাধ্যমের ভিতর দিয়ে প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানালেও, পরবর্তীতে আর সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠেনি। সেখানে নিশ্চিতভাবে বিদ্যায়তনের বাইরে ফোকলোরের প্রায়োগিক ব্যবহারের ধারণার বিরোধিতা করেন কেউ কেউ। তাদের ভিতর অন্যতম একজন বিরোধিতাকারী ছিলেন রিচার্ড এম.ডরসন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ফোকলোরবিদের কাজ হবে বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্রের ভিতর, বাইরের নয়। ডরসন মনে করতেন ফোকলোরবিদদের মূল কাজ হবে গবেষণা, প্রকাশনা এবং পাঠদান, এর বাইরের কাজগুলো ফোকলোরবিদদের বিদ্যায়তনিক কাজগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সেই সঙ্গে শিক্ষাদানের সামগ্রিক পরিবেশও ব্যাহত হবে। পরবর্তী প্রায়োগিক ফোকলোর সম্পর্কে ডরসনের চিন্তার কিছুটা পরিবর্তন হয়। তিনি ১৯৬০ সালে ইন্ডিয়ানার গ্যারি শহরে কারখানার শ্রমিকদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন।
শুধুমাত্র ‘পরিবর্তনশীল সংস্কৃতি’ কে আলাদা করেই সহজাতভাবে প্রায়োগিক ফোকলোরের সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়, তাই সহজাতভাবেই এর সংজ্ঞায়নের ভিতর ডরসন (এবং অন্যরাও) সমস্যা খুঁজে পাচ্ছেন। এই প্রায়োগিক ফোকলোর বিষয়ে বিরোধিতাকারীদের বিরোধিতার যথেষ্ট যথাযথ কারণ রয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে অল্প সংখ্যক প-িত ব্যক্তিদের কাজের তুলনায় একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না-এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়। যারা প্রায়োগিক ফোকলোরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ছিলেন- বিরোধিতা অংশ না নিয়ে, তারা চায় তাদের এই শিক্ষা এবং গবেষণার ফলাফল ফোকলোরের তাত্ত্বিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যবহারিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এবং মানুষের রুচি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখুক।
এই সময় কয়েক বছর পর, কিছু সংখ্যক সংগ্রামী ব্যক্তি প্রায়োগিক ফোকলোরের কাজে যুক্ত হন যারা এই দ্বিবিভাজিত শিবিরের ভিতর থেকে- প্রায়োগিক ফোকলোরের একটি সহজসাধ্য সংজ্ঞায়ন করে। এরপরও একটা নতুন বাগাড়ম্বরপূর্ণতার সৃষ্টি হয় যে, প্রায়োগিক ফোকলোরের চর্চায় ফোকলোরবিদদের ভূমিকা হবে গবেষণা, প্রকাশনা এবং বিদ্যায়তনিক কাজের বাইরের কাজ। এই কার্যক্রম বৃহৎ অর্থে ব্যাখ্যা করা যায়। এর ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের একধরনের বাগাড়ম্বরতার বিষয়গুলো যদিও কিছুটা কমে আসে।
ঐতিহাসিকভাবে, এই আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ কিছু সাহসী ফোকলোরবিদের আগমন ঘটে। যখন বিশ শতকে ফোকলোর ইস্কুল প্রথম গঠিত হলো, উদাহরণের জন্য বলা যায়, তখন থেকেই এর প্রতিষ্ঠাতাদের ইচ্ছা ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে জনগোষ্ঠীর সদস্য এবং সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধনের। যখন ড. মার্টিন লুথার কিং, এবং সিষ্টার রোজা পার্ক একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং নাগরিক অমান্যতা বিষয়ে একত্রিত হয়, হাইল্যা-ের ফোক ইস্কুল অব টিনেসি এর প্রশিক্ষক মাঠ এর আয়োজন করে। ১৯৩০-এর দিকে বোস্টনের জন সি.ক্যাম্পবেল ফোকলোর ইস্কুল, নর্থ-ক্যারোলিনা, কাঠখোদাইকারী প্রতিষ্ঠান এবং সমবায় ভিত্তিক কৃষিজ খামার কার্যক্রমের সঙ্গে নতুন প্রযুক্তির সংযোগ ঘটানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। লক্ষ ছিল গোষ্ঠীগত জীবনের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এভাবে করেই পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে আসল সংজ্ঞাকে প্রায়োগিক ফোকলোরের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস দেখা গিয়েছে। এই ফোকলোর ইস্কুলগুলো চাই- এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেন জীবন যাপনে উপাদানগুলোর ভিতর পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে; যেন অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিক সমস্যার সমাধান করে উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
১৯৯০-এর মাঝামাঝিতে, প্রায়োগিক ফোকলোরবিদগণ জনসাধারণের কাজের ক্ষেত্রে আরো কয়েকধাপ এগিয়ে ছিল। প্রায়োগিক ফোকলোরের প্রথম দিকের আন্দোলনে, প্রায়োগিক ফোকলোরের সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্যের কিছু সম্প্রসারণ ফোকলোরবিদদের কাজের ভূমিকাও প্রসারিত করে এবং সেই কাজের ভূমিকা অনেকাংশেই একাডেমিক কাজের বাইরে। রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠার পর আঞ্চলিক এবং স্থানীয় লোকশিল্প কর্মসূচি, জাতীয়ভাবে লোকশিল্পের জন্য শিল্প বৃত্তিপ্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, লাইব্রেবি অব কংগ্রেসের লোকজীবন কেন্দ্র এবং আমেরিকার লোকজীবনে উৎসব কে নিয়ে এই কাজ করে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক ফোকলোরবিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের বাইরে। বেশির ভাগই ফোকলোরবিদরা নিজেদেরকে পাবলিক-সেক্টরের ফোকলোরবিদ বলে মনে করে। আর একটু যোগ করে বলা যায়, এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ‘সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ’ বিষয়টি তাতে করে সর্বত্রভাবে সমর্থন করে গবেষণা, প্রকাশনা এবং কর্মসূচির ভিতর দিয়ে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বৈচিত্র্যময় পেশার কাজের সুযোগ তৈরি করা। কেউ হয়তো জানতে চাইবে, কিভাবে, যে ব্যক্তি সেই বিষয়গুলোকে মূর্তমান করেছে, যেখানে সামাজিক পরিবর্তন এবং সামাজিক অপ্রাচুর্যতা নিয়ে কাজ করা যায়। এর ফলে প্রায়োগিক ফোকলোরের এই আন্দোলন আসল মানে সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বিষয় আরো বলা যায়, পাবলিক-সেক্টর ফোকলোর-এর ক্ষেত্রে প্রায়োগিক ফোকলোরের সংজ্ঞার যথেষ্ট স্বীকৃত হয়েছে : এখানে কী জনগোষ্ঠীগত সমাজের অংশগ্রহণ থাকে, থাকে তাদের প্রত্যাশা অথবা অভিপ্রায়ের যোগসূত্র, যাতে করে সরকারি উন্নয়ন কর্মগুলোর মাধ্যমে সাধারণের দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়, ক্ষমতায়ন ঘটে? আরো একটু করে বললে যা দাঁড়ায় তা হলো- এই পাবলিক সেক্টর কর্মসূচি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মকা-ের লক্ষ এবং বাস্তবায়ন কী? তার উত্তরের বলা যায়- নৈতিক এবং তাত্ত্বিক কাঠামোতে পাবলিক সেক্টরের কাজগুলো ভিতর দিয়ে আসলে প্রায়োগিক ফোকলোরেরই একটি ব্যাপক সংখ্যার সম্প্রসারণ।
যদিও দৃশ্যমানতা এবং মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতা পাবলিক-সেক্টর ফোকলোর এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ- প্রায়োগিক ফোকলোরের আসল মানে, উক্ত বিষয়গুলো তাই ধারণ করে রাখে। উদাহরণের জন্য বলা যেতে পারে ডেভিড হুফোর্ড এর কথা, যিনি বেশ সচেষ্ট ছিলেন ফোকলোরের তত্ত্ব এবং কৌশলের যথাযথ ব্যবহারের, যেমনটা তার ঔষধ এবং হাসপাতাল ব্যবস্থায়। তিনি দারুণভাবে এগুলোর ব্যবহার করে এর রীতি-নীতি এবং কাঠামাতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। পরিবেশ দূষণ নিয়ে নিয়মিত কাজ করেছেন হাইল্যান্ডার ফোকলোর ইস্কুল, এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের বিষয়ে জোরে-সরে প্রতিবাদ জানাই তারা, দূষণের বিরুদ্ধে। প্রায়োগিক অ্যান্থোপলজি সোসাইটি থেকে ১৯৮৫ সালের দিকে লেসলি পোস্টারম্যান ‘প্যাক্টিসিং ফোকলোর’ একটি বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা করে, যেটি প্যাক্ট্রিসিং অ্যান্থোপলজি জর্নালে প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাটিতে ছিলো সমসাময়িক প্রায়োগিক ফোকলোরের কার্যক্রমের বর্ণনা এবং বিচিত্র সব সচিত্র আলোচনা সমন্বয়। এছাড়াও এখানে ছিল প্রায়োগিক ফোকলোরের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য যোগফল যা ফোকলোরবিদদের পাবলিক সেক্টর ফোকলোর এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ বিষয় বোঝার দ্বার উন্মুক্ত করে। #
মূলগদ্য:ডেভিড এ.বোরস্
ব্যবস্থাপক, ফোকলোর প্রোগ্রাম জন সি.ক্যাম্পবেল ফোকলোর স্কুল, ব্রাসটন, এনসি
-অনুবাদক: জাফর জয়নাল। সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধের অনুবাদের প্রতি তাঁর আগ্রহ রয়েছে। ‘ফোকলোর ও জেন্ডার’, ‘সংগীতনৃবিদ্যা’, ‘সাংস্কৃতিক ইতিহাস’, ‘ফোকলোর এবং চলচ্চিত্র’ এবং ইত্যাদি তাঁর অন্যতম অনুবাদ প্রবন্ধ। এছাড়াও ২০২১ সালে নোবেলে বিজয়ী তানজানিয়ন বংশোদ্ভ’ত লেখক আব্দুলরাজাক গুরনাহ-এর ছোটগল্প ‘আমার মা আফ্রিকার একটি খামারে বাস করতেন’ অনুবাদ করেন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
0 Comments:
Post a Comment