আমার এসএসসি পাসে ছোট ছেলে দুটা পড়ালেখায় উৎসাহ পাবে : আব্দুল হান্নান


চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের কামাত গ্রামের আব্দুল হান্নান। অষ্টম শ্রেনীর পর্যন্ত পড়ালেখার পর, সংসারের দ্বায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে। কৃষি কাজ করেই চালিয়েছেন সংসার। হান্নান নিজে পড়ালেখা বেশিদূর করতে না পারলেও, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে চেয়েছেন বরাবরই। তার বড় ছেলে মাসুদ রানা ও মেয়ে গোলাপী খাতুন দশম শ্রেনীতে পড়ালেখা করলেও শেষপযন্ত এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি। বিষয়টি তাকে অনেকটা কষ্ট দেয়। সেই কষ্ট আব্দুল হান্নানের মনে রয়েই যায়। এখন আব্দুল হান্নানের ছোট ছেলে নাহিদ হাসান রনি ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ও মেজ ছেলে জাহিদ হাসান জনি দশম শ্রেনীতে পড়ে।

এবার আব্দুল হান্নান তেলকুপি জামিলা পারভিন কারিগরি ও ভকেশনাল ইনস্টিউট থেকে কম্পিউটার ট্রেডে জিপিএ ৪.১১ পেতে এসএসসি পাস করেছেন। নিজে এসএসসি পাস করায়, তার ছোট ছেলেরা পড়ালেখায় উৎসাহ পাবে বলে মনে করেন তিনি।

মামলায় জড়িয়েই মহুরীর কাজ, পরে আইডি কার্ডের জন্যই এসএসসিতে ভর্তি   

২০১১ সালে হান্নানের পরিবার বেশ কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে যান, জমিজামা নিয়ে বিরোধে সেই মামলা থেকে নিস্তার পেতে কৃষি কাজ করা হান্নান আসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আইনজীবীর কাছে। মামলার প্রয়োজনেই তাকে ঘনঘনই আসতে হত, আদালতে। আদালতে ঘুরতে ঘুরতে,আইনজীবীর সহকারি হিসাবে কাজ শেখা শুরু করেন এ্যাড আজিজ উদ দৌলা তুফানের কাছে।  এভাবেই চলে যায় কয়েক বছর, তবে আইনজীবী সহকারি হিসাবে কাজের জন্য যে সনদ বা আইডি কার্ড দেয়া হয়, সেটি সংগ্রহ করতে গেলে আব্দুল হান্নান জানেন এসএসসি পাস ছাড়া তিনি পাবেন না মহুরীর কার্ড। তখন কেউ কেউ তাকে নকল এসএসসি সনদ সংগ্রহের পরামর্শ দিলেও তিনি ভর্তি হন স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার অংশ নেওয়ার জন্য।

আব্দুল হান্নান বলেন, ২০১৭-১৮ সালের দিকে এসএসসি সার্টিফিটেক ছাড়া মহুরীর কার্ডটা দিবে না, তখন মানুষ কেউ কেউ বলে যে এটা বানিয়া পাওয়া যায়, দ্যাশে টাকা থাকলে ম্যালা কিছু পাওয়া যায়,হামার একটা জেদ জাগলো যে হাত চলছে, লেখতে পারছি, তখন লেখ্যায় সার্টিফিটেক টা লিব, হ্যামি দু নাম্বার জাল সার্টিফিটেক লিব না। তারপর আলোচনা করলে অনেকে বলল, যে এই বয়সে ভকেশনাল আ্র উনমুক্ত এ রকম সুযোগ আছে। তার দূর না যায়া আমাদের বদিউর মাস্টার আছেন, উনার সাথে আলোচনা করালাম, উনি উনার প্রতিষ্ঠান তেলকুপি স্কুলে আমাকে ভর্তি করাল ২০১৮ সালে। এরপর এসএসসি দিয়্যা পাস কর‌্যাছি।

 

পরিবার সদস্যরা যা বলত

আব্দুল হান্নান বলেন, তিনি সারাদিন বিভিন্ন কাজ করলেও রাতে পড়ালেখা করতেন। তার এ বয়সে এসে পড়ালেখা পরিবারের সদস্যরা কিভাবে দেখত এমন প্রশ্নে, আব্দুল হান্নান বলেন, কেহু কেহু উৎসাহ দিত, তারও আবার কেহু কেহু ফাজলামু করত, কহিত এ বয়সে লেখাপড়া কর‌্যা কি করবা, এ বয়সে তোমার কি কোন চাকুরী হবে, সার্টিফিকেট বানিয়্যায় কি করব্যা। হামি তাদেকে কহ্যাছি আরে সার্টিফিটেকটা বানায় তখন বিভিন্ন রকম কাজে লাগতে পারে, এ বয়সেও কাজ আছে ম্যালা কাজ আছে।
ঘরের মানুষটা বলত ‘‘লেখাপড়া কর‌্যা কি করব্যা জি¦, ছ্যালাপিল্যাকে পড়হাও, তুমি ক্যানে এ বয়সে পড়তে য্যাবা । এমন কর‌্যা বলত । আরে হ্যামি যদি লেখাপড়া করি, দুটা করল না লেখাপড়া আন্ডার ম্যাট্রিক,পরীক্ষা দিলে না, হামি পাসটা করলে, এ ছোট গালার মনে হয় যদি, হার বাপ পাস কর‌্যাছে তো হামরা পাসটা করি। এসব বলেই তাদের উত্তর দিতাম।

হান্নানের এমন সাফল্যের দিনে বাড়িতে নেই স্ত্রী জুমেলা বেগম। তিনি দাওয়াত খেতে গিয়েছেন কয়েকদিন আগে। তাই মোবাইলেই নিজের এসএসসি পাসের খবর স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন হান্নান। সেই কথা বলতে গিয়ে হান্নান বলেন, তাকে বলেছে সার্টিফিটেক তো হইলো, এখন কি কাজে ল্যাগবা লাগো, কি চাকরি করব্যা কর এ কথা কহ্যাছে তার হ্যাসাছে।
আব্দুল হান্নানের এসএসসি পাসে খুশি তার পরিবারের অন্য সদস্য ও প্রতিবেশিরা। শ^শুরের এসএসসি পাসের সাফল্যে খুশি তার পুত্রবধু মোসা.শিল্পী খাতুন। এলাকাবাসিও জানিয়েছেন তাদের উচ্ছাস।

শিক্ষকরা যা বললেন

আব্দুল হান্নানের এমন সাফল্যে খুশি তেলকুপি জামিলা পারভিন কারিগরি ও ভকেশনাল ইনস্টিউটের প্রধান শিক্ষক আনারুল ইসলাম। তিনি বলেন কারিগরি বোর্ডের নিয়ম অনুয়ায়ি ১২ বছরের উর্ধে যে কেউ ৯ম শ্রেনীতে ভর্তি হতে পারে, এখানে বয়সের কোন বাঁধা নেই। এ সুযোগের কারনেই এ বয়সে এসেও আব্দুল হান্নান পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছে। সে এসএসসিতে কম্পিউটার ট্রেড নিয়ে ৪.১১ পেয়ে পাস করেছে। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে এ ৩৯ জন পাস করেছে, এরমধ্যে আব্দুল হান্নান একজন। আর এখন পযন্ত আমার এখান থেকে যারা পাশ করেছে তাদের মধ্যে বয়সের দিন থেকে আব্দুল হান্নানই সবচেয়ে বড়।

বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অহিদুল ইসলাম সুমন জানান, আব্দুল হান্নানের ছেলে তার স্কুলে পড়ালেখা করে, তার শিক্ষার্থীর বাবার এমন সাফল্য তাকেও গর্বিত করেছে। খুবই ভাল লেগেছে যে এতো বয়সেও তিনি পড়ালেখা করেছেন।

বিনোদপুর কলেজের শিক্ষক সফিকুল ইসলাম বলেন, লেখাপড়ার যে কোন বয়স নেই, ইচ্ছা শক্তি থাকলেই সম্ভব, তারই উদহারন এ আব্দুল হান্নান। আমরা চাইব, সে আগামীতে এইচএসসিতে ভর্তি হবে। আমরা তাকে সবধরনের সহযোগিতা করব, যাতে সে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে। 



আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

0 Comments:

Post a Comment

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7