অন্যরকম এক সরকারি কর্মকর্তার গল্প

তিনি সরকারি কর্মকর্তা, পদটা নেহায় কম নয়,জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন, সর্বশেষ একই কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। নাম এ কে এম তাজকির-উজ-জামান। এখানেই এ কর্মকর্তার পরিচয়টা শেষ হতে পারত। কিন্ত না, প্রতিদিনের রুটিন কাজের বাইরেরও যে অনেক কিছুই করার আছে, তাই প্রমান করেছেন এ কর্মকর্তা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে গত দুই বছরের প্রায় ২৮টি প্রকাশনা বের হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মত একটি ব্যাস্ততম কার্যালয়ে রুটিন কাজের বাইরে গিয়েও এমন সৃজনশীল কাজ করা যেতে পারে, তাই যেন দেখিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এ কে এম তাজকির-উজ-জামান।
 


সমৃদ্ধ এই প্রকাশনাগুলিতে তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা আর ছাপানোর জটিল কাজ তিনি এক হাতে সামাল দিয়েছেন। এই জেলার জীবিত সকল মুক্তিযোদ্ধার হাতের লেখা, উদ্দৃতি, পরিচিতি আর ছবি দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে “অগ্নিস্বাক্ষর”; জেলার ৭০৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য, উপাত্ত, ছবি, কৃতি ছাত্র-শিক্ষকের তথ্য সংগ্রহ করে এর মধ্য থেকে ১০০ টি বিদ্যালয়ের তথ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৬৫০ পৃষ্ঠার বিশাল সংগ্রহ “আমার বিদ্যালয়” এর প্রথম খন্ড। ইতোমধ্যেই এই সংকলনটি সমাদৃত হয়েছে। জেলার ৪৫ টি ইউনিয়ন পরিষদের যাবতীয় তথ্য নিয়ে প্রকাশিত “তৃণমূল বার্তা” একটি অত্যন্ত তথ্যবহুল বিশাল প্রকাশনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা নিয়ে লেখা- আমার পিতা শেখ মুজিব; মাকে নিয়ে লেখা- বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা; ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে লেখা- ছোট রাসেল সোনা, শেখ রেহানার বাবাকে নিয়ে লেখা- আমার পিতা---, ভাজপত্র হিসেবে প্রকাশ করে বিভিন্ন স্কুলে বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নোত্তর মুলক বই- “বঙ্গবন্ধুকে জানি” বিপুল সাড়া ফেলেছে। সাত ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, দেশাত্তবোধক কবিতা, বই পড়াকে উৎসাহ দিতে বুকমার্কও ছাপানো হয়েছে।
নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাযাহারুল ইসলাম তরু এই বিষয়ে জানান- আমি আমার অধ্যাপনার সময়কালে জেলা প্রশাসনের এত প্রকাশনা কখনই দেখিনি, অবশ্যই এর জন্য তাজকির সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন।


তার এই কর্মযঙ্গকে সংবাদ কর্মী আব্দুর রব নাহিদ মনে করেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি ক্রিয়েটিভ সেলের কাজই একাই করেছেন তাজকির উজ জামান। সাধারনত দেখা যায়, সিটিকর্পোরেশনের একটি প্রেস উইং বা ক্রিয়েটিভ সেল থাকে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এমন কিছু থাকে না। তবে তিনি যেন তার কাজের মাধ্যমে জানান দিয়েই গেছেন, যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও একটি ক্রিয়েটিভ সেল থাকা প্রয়োজন, যেখানে গুছিয়ে বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন উপায়ে সাধারন মানুষের কাছে পৌচ্ছানো। সেটা প্রকাশনা বা অন্য কোন মাধ্যমে হতে পারে।
শুধু কি ২৮টি প্রকাশনা বের করার পেছনের মানুষ তিনি, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নান্দনিক বেশ কিছু কাজ হয়েছে তার হাত ধরেই। ময়লায় ভরে থাকা কার্যালয়ের ছাদে তার হাত ধরেই হয়েছে ফুলও ফলের বাগান। তিন তলার এই ছাদে এখন প্রায় ১০০ জাতের ফুল, ফল আর ঔষধি গাছের সমারহ। ছাদ ভরা নানা রঙের গাছ, সফেদা গাছে সফেদা আর লেবুর ছড়াছড়ি।

এ, কে, এম, তাজকির-উজ-জামান জানালেন সেবা প্রত্যাশীদের কিছুটা আনন্দ দিতেই এই ছাদবাগান। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রেনিং এর ও আয়োজন করা হচ্ছে এখানে। ইতোমধ্যেই সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা এই বাগান পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছেন। কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে, এম আলী আজম সর্বশেষ এই বাগনে এসে তাঁর মুদ্ধতা প্রকাশ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরতে এই জেলায় গত দুই বছর প্রায় বিশ হাজার জাতীয় পতাকা নিয়ে পতাকা র‌্যালী অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলার নির্বাচিত ১০০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সপ্তাহব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক দেয়ালিকা উৎসব, সৃজনশীল লেখালেখির কর্মশালা তেমিনিই উল্লেখ করার মত ঘটনা। জাতীয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পোষ্টার বিতরণ কিংবা এই জেলার ক্ষুদ্র উদ্দ্যোক্তাদের নিয়ে সেলাই করে জাতীয় স্মৃতিসৌধ বিতরন তেমনই উল্লেখ করার মত ঘটনা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক কমান্ডার রুহুল আমিন জানান- তিনি খুবই জনবান্ধব একজন কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি তাঁর ভালবাসা দেখে আমি অভিভূত।

জেলার ব্রান্ডপ্রোডাক্ট আম নিয়েও কাজ করেছেন ব্যাপক। আমচাষীদের প্রকৃত চাষ পদ্ধতি জানাতে আমের ম্যানুয়েল ও লিফলেট প্রকাশ করেছেন। আমের বিপনন কে উৎসাহিত করতে বানিয়েছেন সুদৃশ্য কাগজের কার্টুন। আম পাড়া উৎসব, আম চাষিদের উন্নত প্রযুক্তির ছোয়া দিতে ইথিলিন চেম্বার ও তাঁর হাত ধরে এই জেলায় বাস্তবে ধরা দিয়েছে। শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার এসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম খান বললেন- তিনি এই জেলায় আমের ব্র্যান্ডিং এ নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। আম কেন্দ্রিক ম্যাংগো ট্যুরিজম কে সামনে নিয়ে আসেন এই কর্মকর্তা। জেলার প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও মানবসৃষ্টি সকল স্থাপনা নিয়ে ভ্রমণ ব্রশিয়ার চলো বেড়াই –একটি ব্যাতিক্রমী প্রকাশনা। পর্যটকদের জন্য প্রকাশিত পর্যটক গাইড আর মোবাইল এপস- “দূরে কোথাও”এই জেলার পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করেছে। পার্শবর্তী জেলা রাজশাহীর রেল ও বিমানবন্দরে ও ঢাকার কল্যানপুরে বিভিন্ন বাস কাউন্টারে এই গাইড ও ব্রশিয়ারের দেখা মিলে। এই জেলার সন্তান ও ব্যবসায়ী ঢাকায় বসবাসরত ইঞ্জিনিয়র মাহাতাব জানালেন- জনাব তাজকিরের উদ্যোগ আমাদের এই জেলা নিয়ে বড় কিছু কাজ করার শক্তি জুগিয়েছে।
এ, কে, এম তাজকির-উজ-জামান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বয় স্কাউটের জেলা কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর কর্মপরিকল্পনায় শহরের ক্লাব সুপার মার্কেটের বিপরীতে সাত তলা নিজস্ব ভবন নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে। শতভাগ স্কাউট জেলা হিসেবে এই জেলা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে স্কাউটের পোষাক বিতরণ, নিজস্ব কম্পিঊটার ল্যাব, ইউনিট লিডার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে এই জেলা এখন এই বিভাগের মধ্যে একটি শক্তিশালী স্কাউটিং জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নেপথ্যে থেকে নয় বরং সামনে থেকে এই নেতৃত্ব দেয়া নিয়ে এই জেলার স্কাউট সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ বললেন – স্যার চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্কাউট কে একশ বছর এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

ক্রীড়াঙ্গনে আর সাংস্কৃতিক চর্চায় জড়িত সবাই তাঁর সহযোগিতা পেয়েছেন অকুণ্ঠভাবে। উদিচীর সাধারণ সম্পাদক জনাব মিথুন বললেন- প্রগতিশীল যে কোন কাজে তাঁর উৎসাহ আর উদ্দীপনা আমাদের সাহস জুগিয়েছে। মঞ্চসজ্জা কিংবা পরিবেশনায় আমারা একসাথে কাজ করেছি। পরিবর্তনের ছোয়া আনতে সক্ষম হয়েছেন নিজ কর্মস্থলেও। সহকর্মীদের নিত্য নতুন প্রশিক্ষণ প্রদান, তাদের নিয়ে টিম তৈরী আর কাজের উপযোগী পরিবেশ তৈরী করেছেন। কাইযেন আর ইনোভেশন চর্চায় উৎসাহ যুগিয়েছেন। সম্পন্ন করেছে একাধিক কাইযেন উদ্দ্যোগ। জনগণ কে সেবা সহজে পৌঁছে দিতে ৫ টি ইনোভেশন উদ্দ্যোগ সম্পন্ন করেছেন।
 

নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের অধক্ষ্য শংকর কুমার কুন্ড বললেন –তিনি জেলা প্রশাসনের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে সারা জেলায় আইসিটি র উন্নয়নে কাজ করেছেন, এই কাজে বহু সময় আমারা একসাথে কাজ করেছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষে জেলার এসডিজি, তিন বছর মেয়াদী, এপিএ, শুদ্ধাচার, ইনোভেশন কর্ম-পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন এ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বিভাগীয় ইনোভেশন টিম কর্তৃক পুরষ্কৃত হয়েছেন। ২০২০ সালে পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরষ্কার।

 

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৭ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০১৮ এর অক্টোবর এ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় যোগদান করেন। সদ্য উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি উপ পরিচালক, স্থানীয় সরকার হিসেবে কর্মরত আছেন। নড়াইল ডিসি অফিসে যোগদান করে, সহকারি কমিশনার (ভূমি), ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা, মুন্সিগঞ্জ, এটুআই প্রকল্প, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে নওগাঁর মহাদেবপুরে কর্মরত ছিলেন। ভূমি অফিসে পরিবর্তন এনে কাইজেন রোল মডেল এওয়ার্ড, ইনোভেশন পুরষ্কার, সেরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। জাপানের ইয়ামাগুচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেডিএস স্কালারশীপ নিয়ে অর্থনীতে মাস্টার্স করেছেন। এই বছর একই স্কালারশীপ এর আওতায় কাওয়ানসাই গাককুইন বিশ্ববিদ্যালয়, ওসাকা কে এডভান্স ম্যানেজমেন্ট এ পিএইচডি এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর গবেষনা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। টিকিউএম ও নাগরিক সেবার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।  




 

 

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

0 Comments:

Post a Comment

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7