চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার প্রত্যন্ত চর নারায়নপুর ইউনিয়নের জীবনমান উন্নয়নে ১৪ দাবি দাওয়া তুলে ধরে জেলা প্রশাসকের কাছে স্ম^ারকলিপি দিয়েছে ইউনিয়নের বাসিন্দারা। বুধবার সকালে উপজেলা পরিষদ চত্বরে তারা উপস্থিত হয়ে উপজেলা পরিষদের নির্বাহী অফিসার নাজমুল ইসলাম সরকারের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
চরাঞ্চলবাসীর পক্ষে দেয়া স্ম^ারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, নদী বেষ্টিত প্রত্যন্ত চর নারায়নপুরের বাসিন্দাদের প্রধান কাজ কৃষি, যদিও এখানকার অনেকেই আধুনিক কৃষির সুফল থেকে বঞ্চিত। এখনো রাস্তাঘাটের উন্নয়ন খুব বেশি হয়নি। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও সেখানে থাকেন না চিকিৎসক। নাগরিক সুবিধার অনেক কিছু থেকেই পিছিয়ে চরের মানুষ গুলো। বিশেষ প্রনোদনার মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহনের মাধ্যমে চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের দাবি তুলে ধরা হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, নারায়নপুর ইউপি’র প্যানেল চেয়ারম্যান মোঃ মোমিন আলী, জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মমিন সাদ্দাম, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি জুবায়ের আহমেদ রনি, নারায়নপুর ইউনিয়ন আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হক, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড মোঃ শামিম রেজা মিলন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিভির পাঠকের জন্য ১৪ দাবির পুরো তুলে ধরা হলো...
১। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় নারায়ণপুর ইউনিয়ন মূলত চরাঞ্চল বেষ্ঠিত। উক্ত ইউনিয়নের বৃহৎ জনগোষ্ঠী কৃষি পেশার সাথে সম্পৃক্ত। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে নারায়ণপুর ইউনিয়ন অন্যান্য ইউনিয়ের তুলনায় এক রকম অবহেলিত ইউনিয়ন। জেলা সদরের সহিত একমাত্র নৌ-পথে চলাচলা করতে হয়।
২। এই ইউনিয়নে মোট চরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ৪৬ বর্গ কিলোমিটার। এই সব চরাঞ্চলে বসবাসকারী জনগনের সংখ্যা আনুমানিক ২৫/২৬ হাজার প্রায়।
৩। নারায়নপুর ইউনিয়নে একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (মেডিকেল) আছে। সেটি সংস্কার করে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের ব্যবস্থা করা জরুরী। উক্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন ডাক্তার নিয়মিত অফিস করলে এলাকার জনগণ কিছুটা হলেও স্বাস্থ্য সেবা পাবে। এ সুবিধা চালু হলে এলাকার জনগণের সদর হাসপাতালে আসার প্রয়োজন অনেকাংশে কমে যাবে।
৪। এই ইউনিয়নের মূলত প্রধান কৃষি চাষাবাদ হচ্ছে ধান, গম, মাসকলাই। আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে কৃষকদের জ্ঞান না থাকার কারণে তেমন কোন সবজি, ফল ও মশলা জাতীয় ফসল উৎপাদন করতে পারে না। কৃষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্থকরী ফসল যেমন মৌসুমী ভিত্তিক যেমন: দেশী-বিদেশী জাতের আলু, তরমুজ, বাঙ্গী, টমেটো, বাদাম, পটল এবং মশলা জাতীয় ফসল হলুদ, আদা, রসুন, পেঁয়াজ চাষাবাদ করা সম্ভব বলে মনে করি।
৫। নারায়ণপুর ইউনিয়ন চরাঞ্চল বেষ্ঠিত এলাকা অন্যান্য এলাকার চেয়ে কিছুটা নীচু হওয়ায় বন্যার সময় এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। প্লাবিত এলাকার লোকজন প্রায় তিন মাস তেমন কিছু কাজ বা চাষাবাদ করতে না পারায় বেকার হয়ে পড়ে এবং অতিকষ্টে জীবন নির্বাহ করি। সুতরাং খাঁচা পদ্ধতিতে বা প্লাস্টিক ঘেরা দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ পরবর্তী মাছ চাষে প্রণোদনার আওতায় আনা হলে চরাঞ্চলের বাসিন্দা সারা বছর মাছ চাষ করতে পারবে এবং অনেক উপকৃত হবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে এলাকার চাষীরা সাবলম্বী হবে বলে মনে করি।
৬। চরাঞ্চলবাসীদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর এবং কৃষি পেশায় সম্পৃক্ত। অল্প সংখ্যক লোক বাড়ী লাগোয়া জায়গায় স্বল্প পরিসরে গরু-হাঁস-মুরগী চাষ বা লালন পালন করে থাকে। পোল্ট্রি শিল্পকে বিকশিত করতে হলে আধুনিক শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। তাই এ খাতে প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা তৈরী ও প্রণোদনা দিয়ে এই শিল্পকে বিকশিত করা হলে চরাঞ্চলে পোল্ট্রি ও পশু পালন ও মৎস্য শিল্পে নতুন দ্বার উন্মোচত হবে, বেকারত্ব দুর হবে, অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে।
৭। সদর উপজেলা হতে এই ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট মেরামত ও নতুন রাস্তা তৈরীর কর্মসূচী গ্রহণ করা হলে উক্ত এলাকার মানুষজন ও শহরাঞ্চলের মানুষজনের চলাচল অনেক সহজ হবে এবং অর্থনৈতিক বিবর্তন সৃষ্টিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে এবং সাথে সাথে বিজিবি সদস্যগণ জরুরী প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারবে।
৮। অত্র জেলার সদর উপজেলাধীন নারায়ণপুর ইউনিয়ন যেতে হলে ২টি নদী (মহানন্দা ও পদ্মা নদী) নৌকায় পার হতে হতো। শেখ হাসিনা ব্রীজ- মহানন্দা নদীতে নির্মিত হওয়ার পরে ৬টি ইউনিয়ন কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেও অপর নারায়ণপুর ইউনিয়ন এখনও অবহেলিত। বিশেষত নারায়ণপুর ইউনিয়ন যেতে হলে পদ্মা নদী পার হতে হয়, সময় লাগে প্রায় ৩/৪ ঘন্টা এবং এই বিশাল পদ্মানদী জীবনের ঝুকি নিয়ে উক্ত ইউনিয়নের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন পারাপার হতে হয় আজ অবধি। শ্যালো নৌকা একমাত্র ভরসা। সুতরাং নারায়াণপুর বাসীদের দীর্ঘদিনের সুপ্ত বাসনা নদী পারাপার সহজ হতে ঝুঁকিমুক্ত সী-বোট প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বরাদ্দ দেয়া হলে অত্র ইউনিয়নবাসী উপকৃত হবে, জীবনযাত্রা সহজ হবে, সময় বাঁচবে।
৯। আমাদের চরাঞ্চল বেষ্ঠিত ইউনিয়নটি অন্যান্য ইউনিয়নের ছেলেমেয়ের তুলনায় শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, খাবার ব্যবস্থা, বইপত্র ও শিক্ষক স্বল্পতা দূর করা হলে শিক্ষার মান অবশ্যই উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। বর্তমানে নারায়ণপুর ইউনিয়নের কিছু এলাকায় সৌর বিদ্যুৎ সুবিধা রয়েছে। কিন্তু কম্পিউটার শিক্ষা ব্যবস্থা নাই। কম্পিউটার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে চরাঞ্চলের সরকারী স্কুলগুলোতে এলাকার শিক্ষকদের দিয়ে স্কুল পরিচালিত হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা মনে করি। কারণ চরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে শহরাঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষকগণ বেশীদিন উক্ত স্কুলগুলোতে চাকুরী না করে অন্যত্র বদলী নিয়ে চলে যাওয়ায় এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। চরাঞ্চলের স্কুল- কলেজ-মাদ্রাসা সকল প্রতিষ্ঠানেই একই সমস্যা। নারায়নপুর ইউনিয়নের পদ্মা নদীর পশ্চিম পাড়ে একটি এমপিও ভুক্ত আলিম মাদ্রাসা ও নন-এমপিও ভুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রতিষ্ঠান দুটোতে কোন ভৌত অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। বিধায় দিন দিন ছাত্র-ছাত্রী কমে যাচ্ছে। তাই জরুরী ভিত্তিতে মাদ্রাসা ও কলেজের শ্রেণী কক্ষ সহ ছেলেমেয়েদের জন্য কমন রুম গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
১০। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের রাস্তা ঘাট চলাচলের উপযোগী থাকলে ইউনিয়নের অসুস্থ জনগণ শহরাঞ্চলে দ্রুত এসে হাসপাতালে জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারবে। সদর উপজেলাধীন নারায়ণপুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের যাতায়াতের একমাত্র নদীপথ হওয়ায় জরুরী স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে সদর উপজেলায় ১টি নৌ-এ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দের আবেদন করছি। কারণ প্রসুতি মায়েরা অনেকেই জরুরী সেবা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই নৌ-এ্যাম্বুলেন্স থাকলে স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিত বৃদ্ধি পাবে।
১১। সর্বোপরি প্রত্যন্ত নারায়নপুর ইউনিয়নে উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং তাদের প্রণোদনার আওতায় আনা হলে আমাদের বিশ্বাস তারা দুগ্ধ খামার, গরু মোটা-তাজাকরণ করে তারা লাভবান হবে পাশাপাশি এলাকার কর্মহীন-দুঃস্থ মানুষজন দিনমজুরের কাজ করে সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে চরাঞ্চলে যে সব খামারী দুগ্ধ উৎপাদন করছেন তারা বিশেষ সুবিধার অভাবে লাভবান হতে পারছেন না। তাদের দুধ সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় এই শিল্প বিকশিত হতে পারছেনা। সরকারী পর্যায়ে চিলিং মেশিন স্থাপন করা হলে এ শিল্প অতিদ্রুত বিস্তার লাভ করবে বলে মনে করি।
১২। বর্তমানে ধান, গম কাটা ও মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিলক্ষিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে উক্ত মেশিনের ব্যবহার চালু ও অন্যান্য মেশিনের সরবরাহ বৃদ্ধি করা হলে কৃষি সেক্টরে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবো।
১৩। বন্যা কবলিত এলাকা হওয়ায় চরাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট বেশীদিন ভাল অবস্থায় থাকেনা। বর্তমানে উক্ত রাস্তাঘাটগুলি যাতে করে দীর্ঘদিন টিকে থাকে সে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে আমাদের সকলের উপকার হবে। প্রকাশ থাকে যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভিজিট করে পরিকল্পনা মাফিক রাস্তা মেরামত করা একান্ত প্রয়োজন।
১৪। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর ঘেঁষা বারঘরিয়া, বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নে যে বরাদ্দ দেয়া হয় সেই একই রকম বরাদ্দ চরাঞ্চল বেষ্ঠিত নারায়ণপুর ইউনিয়নে দেয়া হয় কিন্তু তাতে করে চরাঞ্চল বেষ্টিত ইউনিয়নটির সমস্যা সমাধান হয়না। কারণ সদর উপজেলা হতে পণ্য বহন খরচ বেশী হওয়ার ফলে উন্নয়ন খরচ বেশী হয়, বরাদ্দ বৃদ্ধি হওয়া আবশ্যক। প্রত্যন্ত চরাঞ্চল বেষ্টিত ইউনিয়নবাসীদেরকে সরকার ঘোষিত মধ্যম আয়ের উন্নতি করনের জন্য রাস্তা-ঘাটের সম্প্রসারণসহ সংস্কার, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদান, উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ, পদ্মা নদীপাড় বাধাই ও পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা, দুগ্ধখামারীদের জন্য চিলিং পয়েন্ট নির্মাণ করা হলে উক্ত চরাঞ্চলবাসী অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হবে বলে মনে করি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, যমুনা নদীর চরে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে। সেই আলোকে আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চরাঞ্চলগুলিকে উন্নয়ন করা সম্ভব।
বিনয়ের সহিত উপরে বর্ণিত সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে আমাদের ধারনা উপস্থাপন করলাম।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন https://bit.ly/2Oe737t কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
0 Comments:
Post a Comment