আগামী প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্র’ নির্মাণ

আজ ১৮ অক্টোবর নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সংগ্রামী নেত্রী ইলা মিত্রের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী। মহিয়সী এই নারীর মৃত্যুও এই মাসেÑ ১৩ অক্টোবর। এই প্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁর জন্মবার্ষিকী পালন করা হবেÑ এজন্য সাধুবাদ। এসবই হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের বদান্যতায়। কেননা দেশ স্বাধীনের পর ইলা মিত্র প্রথম নাচোলে এসেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। যতদূর জানি, ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর নাচোল কলেজ মাঠে জনসভা করার পর ৯ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ইলা মিত্র।
ভালো লাগার বিষয় এই যে, ইলা মিত্রকে নিয়ে যে কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৫ সালে শুরু করেছিলাম তারই ধারাবাহিকতায় আজও তাঁকে নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, পাঠাগার গড়ে উঠেছে। আশাবাদ আগামীতে আরও কিছু হবে। এই লেখায় তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই। সেসব সম্পর্কে কমবেশ সকলেই অবগত হয়েছেন। তবে আগামী প্রজন্মের জন্য ইলা মিত্রকে বোঝবার ও জানবার জন্য নাচোলে স্থায়ীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার। এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য জনাব রয়েল বিশ্বাসের সঙ্গে যৌথভাবে এ-বিষয়ক অর্থাৎ ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্র’ নির্মাণের একটি বিশদ পরিকল্পনা জেলা পরিষদে জমা দেয়া হয়েছিল। সে পরিকল্পনার কথা সংক্ষেপে আজ তুলে ধরছি, পুরোটা তুলে ধরা সম্ভব নয় পরিসরের কারণে। সরকারিভাবে ইলা মিত্রের জন্মবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ দেখে অনেকেই এ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন; নাচোলে কী করা যায় তা নিয়েও ভাবনা শুরু হয়েছে। সবই প্রশংসার যোগ্য। তাই ইলা মিত্রকেন্দ্রিক নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরার এখনই সময় বলে মনে করছি।

এটা সত্য যে, মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়েছে বেশ। কালে কালে সময়ও অতিক্রান্ত হয়েছে অনেক। স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে চার দশকে দেশে পরিবর্তনও হয়েছে। মানুষের গতি পাল্টেছে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। আনাচে-কানাচে কাঁচা রাস্তা বদলে পাকা হয়েছে। নদীতে নদীতে সেতু গড়ে উঠেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সাহস দেখিয়েছে দেশ। বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং কমেছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা-চাহিদা বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার কমেছে। সর্বোপরি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার হচ্ছে। পাল্টেছে অনেক কিছুই। আর এসবই সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায়। আর এতসবের মধ্যেও শুধু অবহেলিত থেকে গেছে বরেন্দ্র ভূমির ঐতিহাসিক জনপদ তথা তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ইলা মিত্রের জন্য পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলা।
নাচোল উপজেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কৃষির দিক দিয়েও। ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও এ উপজেলা এখনো অবহেলিত। বিশেষত ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চর্চার দিক থেকে। নাচোল উপজেলার দুঃখ, ইলা মিত্রকে কেন্দ্র করে এ উপজেলার অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটলেও ইলা মিত্র তথা আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জানা-বোঝা বা চেনবার জন্য কিছু নেই। নেই কোনো ইতিহাস-ঐতিহ্য কেন্দ্র, নেই কোনো বরেন্দ্র’র ঐতিহ্য-সংরক্ষিত জাদুঘর, নেই শিশু-কিশোরদের জন্য সুস্থ বিনোদন কেন্দ্র। বাইরের পর্যটকদের থাকবার জন্য নেই কোনো মানসম্মত আবাসস্থল।
এ ভাবনা থেকেই প্রস্তাব হচ্ছে নাচোল উপজেলায় ইলা মিত্রের স্মৃতিবিজড়িত কেন্দুয়া ঘাসুড়া গ্রামে অথবা এর আশপাশে অথবা গ্রামের পাশ দিয়ে বিএমডিএ’র নিয়ন্ত্রণাধীন যেসব খাঁড়ি প্রবাহিত তার পাশে ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্র’ নির্মাণের। এক সীমানার মধ্যে থাকবে পর্যটকদের থাকবার জন্য আবাসস্থল বা মোটেল বা রিসোর্ট, শিশুপার্ক, লোকজ ঐতিহ্য-সংবলিত জাদুঘর, ইতিহাস কেন্দ্র, হস্তশিল্প কেন্দ্র ও পিকনিক কর্নার। সবগুলোই হতে হবে অত্যাধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর। আমাদের বিশ্বাস, নাচোল উপজেলায় ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্র’ নির্মিত হলে উপজেলা-জেলা ও আশপাশের অনেক জেলার মানুষসহ বিদেশী পর্যটক এবং যেসব প্রতিষ্ঠান বনভোজনের আয়োজন করে থাকে তারাও এখানে আসতে অনুপ্রাণিত হবেন। ফলে একদিকে যেমন থাকছে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জানার সুযোগ, অন্যদিকে থাকছে রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনাও।

 রমেন মিত্র পর্যটন মোটেল / রিসোর্ট
নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে ইলা মিত্রের পাশাপাশি তার স্বামী রমেন মিত্রের নামও জড়িয়ে আছে। তাই আমাদের প্রস্তাব ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্রে’র মূল প্রবেশ দ্বারের একদিকে থাকবে রমেন মিত্র পর্যটন মোটেল / রিসোর্টটি। মোটেলে নিদেনপক্ষে ২০০ জনকে নিয়ে মিটিং / গোলটেবিল আয়োজন করার জন্য হলরুম থাকবে। পুরো মোটেল / রিসোর্টে ওয়াইফাই সুবিধা থাকবে। মোটেল / রিসোর্টে রাত্রিযাপনের জন্য মানভেদে বিল পরিশোধ করতে হবে। মোটেল / রিসোর্টের প্রশস্ত সম্মুখ ভাগ থাকবে ফুলের গাছে ভরা। মোটেল / রিসোর্টের সম্মুখ ভাগ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এরপর শিশু পার্ক, জাদুঘরে প্রবেশ এবং খাঁড়িতে ওয়াটার বোটে ওঠার জন্য প্রবেশ ফি দিতে হবে।
‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্রে’র প্রবেশ দ্বার লাগোয়া একটি রিসিপশন সেন্টার থাকবে। যেখান থেকে আগত দর্শক বা পর্যটকরা কেন্দ্র সম্পর্কে ধারণা পাবেন। ইতিহাসসমৃদ্ধ বইয়ের সমাহার নিয়ে থাকবে একটি বুক স্টল।

 শেখ রাসেল শিশু পার্ক
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, নাচোল উপজেলায় শিশুদের সুস্থ বিনোদনের জন্য কোনো বিনোদন পার্ক নেই। ব্যক্তিমালিকানায় যেসব গড়ে উঠেছে, সেগুলোয় আধুনিকতার ছোঁয়া নেই বললেই চলে। তাই শিশুদের সুস্থ বিনোদনের জন্য ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্রে’ একটি ‘শেখ রাসেল শিশু পার্ক’ নির্মাণ করা যেতে পারে। যেখানে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত প্রবেশ ফি রাখা হবে। শিশু পার্কটি হবে সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক এবং ডিজিটাইলাইজড।

 ইলা মিত্র জাদুঘর
‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্রে’র মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকবে ‘ইলা মিত্র জাদুঘর’। জাদুঘরের সম্মুখে থাকবে ইলা মিত্রসহ যেসব ব্যক্তি নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের ম্যুরাল। নাচোল উপজেলায় সংঘটিত তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত নানা উপাদান সংগ্রহ করে এখানে সংরক্ষণ করা হবে। ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর নাচোল ডিগ্রি কলেজ (বর্তমানে সরকারি কলেজ) মাঠে অনুষ্ঠিত ইলা মিত্রের জনসভার ভিডিও চিত্র কারো কাছে থেকে থাকলে তা সংগ্রহ করে জাদুঘরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা। থাকবে নাচোল উপজেলার লোকজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এটা অনস্বীকার্য যে, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় যান্ত্রিকতার বহুমাত্রিক ব্যবহারের ফলে লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগুলো হারাতে বসেছে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেসবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে তার সংরক্ষণ জরুরি। জাদুঘরে সে চেষ্টাই থাকবে। জাদুঘরে প্রবেশে নির্ধারিত ফি রাখা হবে।

 বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইতিহাস কেন্দ্র
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস জাতির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আজীবন বহমান। আমরা ইতিহাসনির্ভর বইয়ের মাধ্যমে। অনেক শিশু-কিশোরই পাঠ্যবইয়ের চাপে ইতিহাসবিমুখ হয়ে পড়ছে। তাদেরকে বিনোদনের মাধ্যমে ইতিহাসপ্রিয় করার জন্য ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্রে’র ভেতরে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইতিহাস কেন্দ্র’ গড়ে তোলা যেতে পারে। যেখানে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পটভূমি থেকে শুরু করে ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সময় পর্যন্ত পুরো ইতিহাস এবং জাতির যেসব উল্লেখযোগ্য সন্তান জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের জীবনপঞ্জী ইতিহাস কেন্দ্রে থাকবে। ইতিহাস কেন্দ্রের শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল থাকবে। ভেতরে থাকবে যারা ওই সময়ের ইতিহাসের অংশবিশেষ তাদেরও ম্যুরাল। ইতিহাস কেন্দ্রে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্যালারি’ নামে আলাদা একটি গ্যালারি রাখা যেতে পারে। ইতিহাস কেন্দ্রে প্রবেশ মূল্য রাখা হবে।

 শেখ আজাহার হোসেন হস্তশিল্প কেন্দ্র
নাচোলে সংঘটিত তেভাগা আন্দোলনে ইলা মিত্র ছাড়াও সক্রিয় নেতৃত্বে ছিলেন শেখ আজাহার হোসেন। তাই ‘শেখ আজাহার হোসেন হস্তশিল্প কেন্দ্র’ নামে একটি আলাদা কর্নার রাখা যেতে পারে। কেননা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার হস্তশিল্পের সুনাম গোটা দেশজুড়ে বিস্তৃত। হস্তশিল্প কেন্দ্রে জেলার হস্তশিল্প স্থান পাবে।

 মাতলা সর্দার-বৃন্দাবন সাহা পিকনিক কর্নার
নাচোলে সংঘটিত তেভাগা আন্দোলনে ইলা মিত্র ছাড়াও নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতলা সর্দার ও বৃন্দাবন সাহা। তাই এ দুজনের নামে ‘মাতলা সর্দার-বৃন্দাবন সাহা পিকনিক কর্নার’ নামকরণ করা যেতে পারে। পিকনিক কর্নারে ১০টি আলাদা স্পট থাকবে, যেখানে ১০টি গ্রুপ পিকনিক করতে পারবে। প্রত্যেকটি স্পটে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকবে। ১০টি স্পটে ১০টি রান্নাঘরের ব্যবস্থার পাশাপাশি একসঙ্গে ১০০ জনের খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য ছাউনি থাকবে। ছাউনির এক প্রান্তে একটি উঁচু মঞ্চ রাখা যেতে পারে। প্রত্যেকটি স্পটে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকবে। পিকনিক কর্নারে প্রবেশের আলাদা রাস্তা থাকবে এবং কর্নার ঘেঁষা গ্যারেজের ব্যবস্থা থাকবে। গ্যারেজে ৫০টি বাস রাখার ব্যবস্থা থাকবে।

আমাদের বিশ্বাস, নাচোল উপজেলায় ‘ইলা মিত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেন্দ্র’ নির্মাণ হলে দেশের মানচিত্রে একটি আলোকিত উপজেলা হিসেবে চিহ্নিত হবে নাচোল। তাছাড়া এ উপজেলায় এটি গড়ে উঠলে এখানকার মানুষের জীবনযাপনেরও মানোন্নয়ন ঘটবে। ইতিহাস-সংস্কৃতির চর্চাও তৈরি হবে কিশোর-তরুণ-যুবসমাজের মধ্যে। সর্বোপরি দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে নাচোল উপজেলা। আমাদের আকাক্সক্ষা, এ প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সরকার সম্মত হবেন এবং নাচোল উপজেলাকে দেশ তথা বিশ্বের মানচিত্রে আলোকিত করতে আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন।


সাজিদ তৌহিদ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক


কনটেন্ট চুরি আপনার মেধাকে অলস করে তুলে, আমরা এ নিন্দনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করি। এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

About chapainawabganj tv

বিজ্ঞাপন

src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-5331163805288347" crossorigin="anonymous">

7